রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় চারটি সিটি করপোরেশন রয়েছে। এসব সিটি এলাকায় ২১ লাখের বেশি ভবন ও স্থাপনা রয়েছে। এর সঙ্গে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন যোগ করলে এই সংখ্যা ২৫ লাখ ছাড়াবে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এসব ভবনে প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার সংযোগ দিয়েছে। এর বাইরে রয়েছে অবৈধ সংযোগ। বৈধ–অবৈধ অনেক সংযোগ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের আশঙ্কা, এসব সংযোগ থেকে গ্যাস জমে যেকোনো সময় গুলিস্তানের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত রাসায়নিক দ্রব্য থেকে দুর্ঘটনা ঘটার সময় আগুন লাগে। কিন্তু তিতাসের লাইনে লিকেজ বা ছিদ্র থাকলে কেউ বুঝে ওঠার আগেই আশপাশে গ্যাস জমতে থাকে। এই এলাকা যদি বদ্ধ হয়, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সামান্য শর্টসার্কিট বা দেশলাইয়ের আগুন থেকে ওই গ্যাস বিস্ফোরিত হতে পারে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। যেকোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। আগে কেউ কেউ হয়তো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় অবহেলা করতেন। এখন কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হয়।
গ্যাস–সংযোগগুলো একবার দেওয়ার পর আর তদারকি করা হয় না। গ্যাসলাইনে কোনো ছিদ্র হলো কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় না। পাইপলাইন থেকে গ্যাস জমে সামান্য আগুন বা কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারেঅধ্যাপক মো. আবু বিন হাসান, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা, বিপণন, পরিবহন ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালে সরকার একটি স্বতন্ত্র অথোরিটি বা কর্তৃপক্ষ গঠনের পরিকল্পনা করে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস ধরনের ওই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে একটি কারিগরি কমিটি করা হয়। ওই কমিটি তিনটি সভা করে একটি সুপারিশও তৈরি করেছে। ২০২১ সালের ২১ মে সর্বশেষ সভায় ওই সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংস্কার ও সমন্বয় বিভাগের তৎকালীন সচিব কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ওই সভা হয়। সেখানে রাজধানীর বাসাবাড়িতে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা ও তিতাসের গ্যাসলাইন থেকে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস কীভাবে কাজ করবে, তা নিয়েও সুপারিশ করা হয়।
কোনো ভোক্তা বা ভুক্তভোগী অথবা সচেতন নাগরিকের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনা এড়াতে সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও সুপারিশে বলা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত ওই সুপারিশ নিয়ে আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকারের সাতটি মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মোট ১২টি সরকারি সংস্থা ওই কমিটির সদস্য ছিল। তারা সর্বশেষ সভায় উপস্থিত হয়ে তাদের মতামতও দেয়। কিন্তু এরপর আর কোনো কাজ এগোয়নি।
জানতে চাইলে ওই কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. আবু বিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকাসহ বেশির ভাগ বড় শহরে গ্যাস ও পয়োনিষ্কাশন লাইনে অগ্নিসংযোগ ছাড়াই বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে গ্যাস–সংযোগগুলো একবার দেওয়ার পর আর তদারকি করা হয় না। গ্যাসলাইনে কোনো ছিদ্র হলো কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় না। পাইপলাইন থেকে গ্যাস জমে সামান্য আগুন বা কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। গ্যাস সংযোগ আছে, এমন অনেক ভবনে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি আছে বলে তাঁরা দেখতে পেয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ, ২০২১ সালে মগবাজারের একটি ভবনে বিস্ফোরণ, গত কয়েক দিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও সর্বশেষ গুলিস্তানের ভবনে বিস্ফোরণের জন্য জমে থাকা গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে।
তিতাস ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করে। সংস্থাটির প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার বৈধ সংযোগ আছে। এর মধ্যে ২৮ লাখ ১৮ হাজার বাসা-বাড়িতে, বাকিগুলো শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে লক্ষাধিক অবৈধ সংযোগ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও সেখানে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয় না। ফলে সেখান থেকে গ্যাস বের হয়ে অতীতে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে একের পর এক গ্যাস–সংযোগ থেকে দুর্ঘটনা ঘটছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এ জন্য তিতাসসহ গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও দুর্নীতি দায়ী। তাদের অবহেলায় অনেক ভবনের গ্যাসলাইন একেকটি ঘুমন্ত বোমায় পরিণত হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত, গুলিস্তানের ওই দুর্ঘটনার জন্য তিতাসসহ সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তারা তদন্ত করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করে। দায় চাপায় ভোক্তাদের ঘাড়ে। এগুলো বন্ধ না করলে মৃত্যুর এই মিছিল থামবে না।