শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর হস্তান্তর
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও গৌরবে দীপ্ত আয়োজন
শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামী জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামানের হাতে স্মৃতি জাদুঘরের চাবি তুলে দেন। এখন থেকে জাতীয় জাদুঘরের আওতাভুক্ত নবম শাখা জাদুঘর হিসেবে শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরটি পরিচালিত হবে।
স্মৃতি-বেদনা, আত্মদানের মহানুভবতা, বীরত্বের গৌরব ও প্রেরণায় প্রোজ্জ্বল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ‘শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর’ জাতীয় জাদুঘরের শাখায় পরিণত হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে চাবি হস্তান্তরের মাধ্যমে ব্যক্তি উদ্যোগের এই জাদুঘর রূপায়িত হলো জাতীয় প্রতিষ্ঠানে।
আজ শনিবার সকালে জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামী জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামানের হাতে স্মৃতি জাদুঘরের চাবি তুলে দেন। পাশে ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, অনুষ্ঠানের সভাপতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
এ সময় মঞ্চের নেপথ্যের ডিজিটাল পর্দায় শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও তাঁর বড় ছেলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফি ইমাম রুমীর প্রতিকৃতি এবং স্মৃতি জাদুঘরের নিদর্শনগুলোর দৃশ্য ভেসে ওঠে।
মঞ্চে অতিথিদের পেছনে সারি করে বসা অর্কেস্ট্রা দল পরিবেশন করে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত উদ্দীপনাময় গানের সুর। কানায় কানায় ভরা মিলনায়তনে দর্শকদের মধ্যে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এক আবেগময় পরিবেশ সৃষ্টি হয় মিলনায়তনজুড়ে।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। গতকাল শুক্রবার ৩ মে ছিল তাঁর ৯৫তম জন্মদিন। ছুটির দিন থাকায় পরের দিন অর্থাৎ আজ শনিবার তাঁর জন্মদিন উপলক্ষেই স্মৃতি জাদুঘর আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর অনুষ্ঠানের এই আয়োজন করা হয়েছে বলে স্বাগত বক্তব্যে বললেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। এখন থেকে জাতীয় জাদুঘরের আওতাভুক্ত নবম শাখা জাদুঘর হিসেবে শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরটি পরিচালিত হবে।
প্রধান অতিথি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মল হক ভার্চ্যুয়ালি স্মৃতি জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন। নেপথ্যের অর্কেস্ট্রায় ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটির সুর বাজানো হয়। প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণে বলেন, শহীদজননীর পুরো জীবন ছিল সংগ্রামময়। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বড় ছেলে শাফি ইমাম রুমী শহীদ হয়েছেন। স্বামী স্থপতি শরীফ ইমামকে হারিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তাদের প্রতীকী বিচারের আয়োজন করে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করার মধ্য দিয়ে শহীদ পরিবারের কাছে কিছু হলেও ঋণ শোধ করেছে। জাতিকে দায়মুক্ত করেছে। প্রধান অতিথি ব্যক্তিগত সম্পদ সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য সাইফ ইমাম জামীকে ধন্যবাদ জানান।
মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ তাঁর বক্তব্যে রণাঙ্গনে শহীদ রুমীর স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, রুমী শহীদ হলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পরে জাহানারা ইমামের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সব মুক্তিযোদ্ধার ‘মা’ হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি ‘শহীদজননী’ হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। পুত্র ও স্বামীকে হারানোর শোক, ব্যক্তিগত জীবনের অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি দেশের এক গভীর সংকটকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে নেমে যে বিপুল গণ–আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সাইফ ইমাম জামী বলেন, ১৭ বছর আগে ছোট পরিসরে তিনি তাঁদের এলিফ্যান্ট রোডের ‘কণিকা’ নামের বাড়িটিতে স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখন সেখানে পাঁচ হাজারের বেশি নিদর্শন রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। সেখান থেকে জাদুঘরটি পরিচালনা করা সহজ নয়। তা ছাড়া সপ্তাহে কেবল এক দিন শনিবার স্মৃতি জাদুঘরটি খোলা থাকত। ফলে অনেকের আগ্রহ থাকলেও স্মৃতি জাদুঘরে আসতে পারতেন না। এসব বিষয় বিবেচনা করে তিনি স্মৃতি জাদুঘরটি সরকারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে এই স্মৃতি জাদুঘর পরিচালিত হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বলেন, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরটি এখন জাতীয় জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানে দর্শকসংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি পাঠ্যপুস্তকে শহীদজননীর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানটি ছিল সুপরিকল্পিত ও সুন্দর। প্রথম পর্বের আলোচনা ও চাবি হস্তান্তরের পরে মঞ্চে রাখা শহীদজননীর প্রতিকৃতিতে লাল গোলাপের স্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। অতিথিরাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ফেরদৌসী মজুমদার আশির দশকে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীদের পক্ষে আয়োজিত শহীদজননীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপও এ সময় পর্দায় দেখানো হয়। এভাবেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় পর্ব।
অর্কেস্ট্রা দল যন্ত্রে পরিবেশন করে ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে’, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’সহ বেশ কয়েকটি গানের সুর। এরপর মঞ্চে আসেন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার ও সঞ্চালক আপন আহসান। তাঁরা একাত্তরের দিনগুলি বই থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ পাঠ করে শোনান। নেপথ্যে থেকে অর্কেস্ট্রা দল পরিবেশন করে করুণ সুর। বিশেষ করে রুমীর যুদ্ধে যাওয়ার দিনগুলো, যুদ্ধের মাঝে বাড়িতে ফিরে আসা, তাঁর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বিবরণের সময় অনুষ্ঠানে এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দী পরেও এক গেরিলাযোদ্ধার আত্মত্যাগ, এক সন্তানহারা মায়ের অতল বেদনার সেই বিবরণ অনেক শ্রোতার চোখ সজল করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের যেমন শোক আছে, তেমনি আছে বিজয়ের গৌরব। তাই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়েছিল উদ্দীপনাময় গানে গানে। যে শিল্পীরা সেই গানগুলো গেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তাঁদের মধ্য থেকে চারজন তিমির নন্দী, শাহীন সামাদ, রফিকুল আলম ও ডালিয়া নওশীন গেয়ে শোনালেন ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙর তোলো তোলো’ গানগুলো।