ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলররা নেই, সেবা পাচ্ছেন না নগরবাসী

কাউন্সিলরদের একটি বড় অংশ অনুপস্থিত। ১৪ ধরনের সেবা পাচ্ছেন না নাগরিকেরা।

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পানির ট্যাংক এলাকা। ওই এলাকার ১ নম্বর গলিতে ঢাকা উত্তর সিটির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোরকান হোসেনের কার্যালয়। গলিপথ থেকে একটু ভেতরে দুটি বহুতল ভবনের মধ্যের ছোট একটি রাস্তা ধরে কাউন্সিলর কার্যালয়ে যেতে হয়। কিন্তু ছোট ওই রাস্তায় রাখা হয়েছে ইট-কংক্রিটের স্তূপ। রাস্তার এক পাশের একটি ভবনের ভাঙার কাজও চলছে। ফলে কিছুক্ষণ পরপরই ওপর থেকে রাস্তায় আছড়ে পড়ছে ইটের টুকরো। এ কারণে কার্যালয়টিতে যাওয়া যাচ্ছে না।

মঙ্গলবার দূর থেকে কার্যালয়টির ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন জানালেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকেই কার্যালয়টি বন্ধ। ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা সচিব, কেউই কার্যালয়ে আসছেন না। কিন্তু বিভিন্ন সেবা নিতে প্রতিদিন অনেকেই কার্যালয়ে গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

কর্মস্থলে ফেরার জন্য কাউন্সিলরদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে যাঁরা কার্যালয়ে ফিরবেন, তাঁদের একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দিয়ে নাগরিক সেবার কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ

ঢাকার দুই সিটির ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে ১৪ ধরনের নাগরিক সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম সেবা হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন। এ ছাড়া নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ), আয়, অবিবাহিত, ২য় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদও দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর দিতে হয় কাউন্সিলরকে। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকি এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কাজও পরিচালিত কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে।

ওই এলাকার তিনজন বাসিন্দা বলেন, কাউন্সিলর ফোরকান কারণে–অকারণে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন চালিয়েছেন। জনরোষ থেকে বাঁচতেই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।

সেবা নিতে মঙ্গলবার দুপুরে ফোরকান হোসেনের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আগারগাঁওয়ের তালতলার বাসিন্দা শাহজাহান ইসলাম। তাঁর ছেলের জন্মনিবন্ধন করানো প্রয়োজন বলে জানালেন তিনি। শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে এখন পর্যন্ত মোট চার দিন এলাম। কিন্তু এক দিনও কার্যালয়টি খোলা দেখতে পাইনি। কবে চালু হবে, এ তথ্যও কেউ দিতে পারছেন না।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেবা চালু রাখার জন্য আমাদের সমস্যা হচ্ছে। তবে দ্রুত এসব কাটিয়ে ওঠা যাবে
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান

কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন ও ওয়ার্ড সচিব জাকির হোসেনের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু দুজনের নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে। ওই এলাকার তিনজন বাসিন্দা বলেন, কাউন্সিলর ফোরকান কারণে–অকারণে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন চালিয়েছেন। জনরোষ থেকে বাঁচতেই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।

ঢাকা উত্তর সিটির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একেবারেই অনুপস্থিত থাকছেন, সেসব জায়গায় আঞ্চলিক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

অপর দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেবা চালু রাখার জন্য আমাদের সমস্যা হচ্ছে। তবে দ্রুত এসব কাটিয়ে ওঠা যাবে।’

কর্মস্থলে ফেরার জন্য কাউন্সিলরদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে যাঁরা কার্যালয়ে ফিরবেন, তাঁদের একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দিয়ে নাগরিক সেবার কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ

উত্তর সিটিতে ১১ ওয়ার্ডে সেবা বন্ধ

ঢাকা উত্তর সিটিতে ৫৪ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রয়েছেন। এর মধ্যে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরসহ অন্তত ১১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। তাঁরা কোথায় আছেন, সেটাও কেউ জানেন না। মুঠোফোনেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ওই ওয়ার্ডগুলোয় সেবা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

তেজগাঁওয়ের কলোনি বাজার এলাকায় মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সফিউল্লাহর কার্যালয়ও বন্ধ দেখা গেছে। ৪ আগস্ট ওই কার্যালয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করার পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। কার্যালয়ে নিচতলার ওয়ার্ড সচিবের কক্ষে ভবনের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। ওই ওয়ার্ডের সচিব আনোয়ারুল কবির প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার কক্ষে থাকা কম্পিউটার ও প্রিন্টার লুট করে নিয়ে গেছে। আসবাব ও কাগজপত্র সব পুড়ে গেছে। প্রতিদিনই অনেকে বিভিন্ন সনদের জন্য আসছেন। কিন্তু কাউকে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। কাউন্সিলর কোথায় আছেন, তা–ও জানি না।’

দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ড সচিবদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, কার্যালয়ের বাইরে থেকে (বাসা কিংবা অন্য জায়গা) বিভিন্ন সনদপত্রে স্বাক্ষরের কাজ করছেন অনেক কাউন্সিলর। এমন কাউন্সিলরের সংখ্যা ২৭। বাকি ১৬ জন কাউন্সিলর বিভিন্ন সনদে স্বাক্ষর করতে অল্প কিছু সময়ের জন্য কার্যালয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ঢাকা উত্তর সিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪৮ জনই কার্যালয়ে গিয়ে অফিস করছেন না। বাকি কাউন্সিলররা নিজেদের কার্যালয়ে গিয়ে অফিস করছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কাউন্সিলরের উপস্থিতি–সংক্রান্ত এ প্রতিবেদন আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

সেবা মিলছে না দক্ষিণ সিটিতেও

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটি করা হয়ে থাকে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে। এ কারণে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এ সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু বিভিন্ন সনদ নেওয়ার মতো বাকি যেসব সেবা কাউন্সিলর কার্যালয়কেন্দ্রিক, তা তাঁরা পাচ্ছেন না। কারণ, এই সিটির ৬৬টি জন কাউন্সিলরের এখনো কোনো হদিস নেই। এসব ওয়ার্ডের কোনো কোনো কাউন্সিলরের কার্যালয় ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ওয়ার্ড সচিবরা পর্যন্ত ভয়ে অফিসে যাচ্ছেন না। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ওয়ার্ড রয়েছে ৭৫টি।

 চানখাঁরপুলের হোসেনি দালান এলাকায় দক্ষিণ সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় কার্যালয়টি ভাঙচুর করার পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কার্যালয়ের সামনে ওয়ারিশান সনদ নিতে ওই কার্যালয়ে গিয়েছিলেন রাবেয়া বেগম ও তাঁর ছেলে ফরহাদ হোসেন। কার্যালয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে যান তাঁরা।

এদিকে কাউন্সিলররা না থাকায় মশার ওষুধ ছিটানোর কাজেও কর্মীরা গাফিলতি করছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ছয়জনের মধ্যে চারজন কর্মী কাজ করছেন, বাকি দুজন কাজে যাননি। ছুটিতে আছেন ওয়ার্ডটির মশকনিধন কাজের তত্ত্বাবধানকারীও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ সিটির বেশির ভাগ ওয়ার্ডের একই অবস্থা।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কর্মস্থলে ফেরার জন্য কাউন্সিলরদের এক সপ্তাহ সময় দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে যাঁরা কার্যালয়ে ফিরবেন, তাঁদের একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দিয়ে নাগরিক সেবার কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়।