ঢাকা উত্তর সিটিতে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, মানুষের দুর্ভোগ
বেশি দুর্ভোগ দক্ষিণখান, উত্তরখান, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে। পরিস্থিতি এমন যে কিছু সড়কে এখন হাঁটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
জুলাইয়ের শুরুর দিকে রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়া মসজিদ সড়কের সংস্কারকাজ শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এর পর থেকে তিন মাস এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর কারণ সড়কের কিছু জায়গা কাটা হয়েছে। আবার কিছু অংশে ফেলে রাখা হয়েছে নালা নির্মাণের জন্য আনা কংক্রিটের পাইপ। পরিস্থিতি এমন যে এখন হাঁটাও কঠিন হয়ে পড়েছে এ সড়কে।
এ সড়কের পাশের একটি খাবার হোটেলের মালিক ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় গত মঙ্গলবার। তিনি বলেন, আন্দোলন (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) শুরু হওয়ার পর সড়ক সংস্কারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ঠিকাদারের লোকজন আর আসছেন না। তাঁদের খননযন্ত্রটিও (এক্সকাভেটর) পড়ে আছে। মানুষের চলাচলে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আবার বৃষ্টি হলে এ সড়কে জলাবদ্ধতা হয়। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি জমে।
কাজীপাড়া মসজিদ সড়ক প্রায় ৮০০ মিটার দীর্ঘ। এ সড়ক দিয়ে কাজীপাড়া থেকে মিরপুর ৬০ ফুট এলাকায় যেতে হয়। প্রতিদিন হাজারো মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে এ সড়ক পার হতে হয়।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, কাজীপাড়া মসজিদ সড়ক সংস্কারকাজের ঠিকাদার মাইশা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ পারভেজ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তাঁকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
তবে মোহাম্মদ পারভেজের সঙ্গে বুধবার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতে পেরেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, শিগগিরিই আবার কাজ শুরু হবে।
কাজীপাড়ার ওই সড়কই নয়, ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন অনেক এলাকার সড়ক ও অলিগলি খোঁড়াখুঁড়ি-কাটাকাটি কিংবা খানাখন্দের কারণে এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোথাও সড়ক সংস্কারের কাজ করছে খোদ সিটি করপোরেশন। কোথাও আবার ঢাকা ওয়াসার পানির সরবরাহের সংযোগ স্থাপন ও অন্যান্য সেবা সংস্থার উন্নয়নকাজের জন্য সড়ক কেটে রাখা হয়েছে। আবার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক এলাকার সড়কের পিচ উঠে খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় সড়ক রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ১৯০ কিলোমিটার, সংযোগ সড়ক (সেকেন্ডারি রোড) প্রায় ৩৪৫ কিলোমিটার ও অলিগলির সড়ক প্রায় ৮০৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে ১৫০ কিলোমিটারের বেশি সড়কের সংস্কার বা মেরামত এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৭১ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। সড়ক সংস্কারের সঙ্গে ৬১ কিলোমিটার নালা ও ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত নতুন করে নির্মাণ করা হবে। আর চলতি অর্থবছরে সড়ক সংস্কার (নালা ও ফুটপাত নির্মাণসহ) কাজে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, যেসব সড়কে ছোটখাটো গর্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। যেসব সড়ক বিভিন্ন সংস্থা কাটছে, তাদের কাজ শেষ হওয়ার পর তা মেরামত করা হবে।
বছরজুড়ে কাটাকাটি-খোঁড়াখুঁড়ি
মোহাম্মদপুর এলাকার বেশির ভাগ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় এ বছরের শুরুতে। সেখানকার বিভিন্ন সড়কের নিচ দিয়ে নালা নির্মাণের জন্য পাইপ বসাচ্ছে সিটি করপোরেশন। আবার কিছু সড়কে ঢাকা ওয়াসা পানির পাইপ বসাচ্ছে। আবার কিছু সড়ক কাটা হয়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের লাইন বসাতে। ফলে পুরো মোহাম্মদপুর এলাকার বেশির ভাগ সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ।
গত মঙ্গল ও বুধবার মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আসাদ গেট থেকে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ পর্যন্ত সড়কের এক পাশে প্রায় দুই ফুট চওড়া করে কাটা হয়েছে। কাটা অংশ দেবে গিয়ে মূল রাস্তা থেকে নিচু হয়ে গেছে। আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সড়ক আসাদ অ্যাভিনিউর চিত্রও একই। এ ছাড়া কাটাসুর, শের-শাহ সুরি রোড, তাজমহল রোড, বাঁশবাড়ি রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড ও নুরজাহান রোডের সংযোগ সড়কগুলোর (বাইলেন) কোথাও এক পাশে, আবার কোথাও কিছু দূর পরপর আড়াআড়ি করে কেটে রাখা হয়েছে।
মোহাম্মদপুরে নবোদয় ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের প্রধান রাস্তা, রিং রোড, ইকবাল রোড, আওরঙ্গজেব রোড, গজনবী রোড, শাহজাহান রোড, হাজি চিনু মিয়া রোড, জান্নাতবাগ, বাবর রোড, মাদ্রাসা রোডেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।
মোহাম্মদপুর এলাকা ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫–এর আওতাধীন। এ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি লাইন বসাচ্ছে। ওয়াসার ঠিকাদার সড়ক খননের নীতিমালা না মানার কারণেই মানুষের ভোগান্তি বেশি হচ্ছে।
চলাচল অনুপযোগী ৬০ ফুট সড়ক
আগারগাঁও থেকে পীরেরবাগ হয়ে মিরপুর-২ পর্যন্ত ৬০ ফুট সড়কের (কামাল সরণি) তিন কিলোমিটার অংশ এখন যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর পীরেরবাগ এলাকায়। সেখানকার সড়কে কিছু দূর পরপর ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো অংশে সড়ক দেবে গেছে। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা উত্তর সিটির কর্মীরা ওই সড়কের গর্ত ভরাটের জন্য পরিত্যক্ত ইটের টুকরা (রাবিশ) ফেলছিলেন।
পীরেরবাগের বাসিন্দা আকমল হোসেন বলেন, সড়কের অবস্থা এমন যে রিকশায় উঠলেও উল্টে যাওয়ার ভয় করে। এ সড়ক অটোরিকশা–রিকশায় পার হওয়ার সময় কোমর ব্যথা হয়ে যায়। আবার সড়ক ভাঙাচোরা হওয়ায় যানজট হচ্ছে।
৬০ ফুট সড়ক ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৪–এর অধীন। এ অঞ্চলের প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৬০ ফুট সড়ক চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোনোরকমে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু মেরামত করা হচ্ছে। একটি প্রকল্পের আওতায় এ সড়ক সংস্কার করা হবে বলে জানান তিনি।
আরও যেসব সড়ক বেহাল
গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলীর দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও মিরপুর সড়কের অবস্থাও খারাপ। সড়কের পিচঢালাই বিভিন্ন জায়গায় উঠে গেছে। দেবে গিয়ে কিছু অংশ উঁচু–নিচু হয়ে আছে। অনেক দিন ধরেই সড়কের এ অবস্থা বলে জানান বাসচালকেরা।
উত্তর সিটির প্রকৌশলীরা বলছেন, এ সড়কে বড় ধরনের সংস্কারকাজ করতে হবে। নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় সড়ক মেরামত করলে তা টেকসই হবে না।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে নতুন যুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রাজধানীর উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। উন্নয়নকাজের কারণে সড়ক খুঁড়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় বৃষ্টি ও নালার পানিতে চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন ওই দুই এলাকার সাতটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশল বিভাগের হিসাবেই ওই সব এলাকার ৯০ শতাংশ সড়ক এখন চলাচলের অনুপযোগী।
এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে গতকাল শুক্রবার সকালে দক্ষিণখান বাজারে মানববন্ধন করেন বাসিন্দারা। ‘দক্ষিণখান-উত্তরখান সচেতন নাগরিক কমিটি’ আয়োজিত ওই মানববন্ধন থেকে দ্রুত সড়কের কাজ শেষ করে চলাচলের উপযোগী করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
দক্ষিণখান-উত্তরখান সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ইয়াছিন রানা মানববন্ধনে বলেন, সড়ক খনন নীতিমালা না মেনে সব সড়ক একসঙ্গে কাটায় মানুষ স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করতে পারছে না। বৃষ্টি হলে ভোগান্তির সীমা থাকে না। তখন হাঁটার মতো অবস্থাও থাকে না।