অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিটি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সুপারিশ পরে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। অতীতেও অনেক বিষয়ে ভালো ভালো সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি। এবারও যদি সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
বুধবার বিকেলে বাসদ (মার্ক্সবাদী) আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ ও সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় এ কথাগুলো উঠে আসে। জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে এ আলোচনায় বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক চিন্তকেরা অংশ নেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বাসদের সমন্বয়ক মাসুদ রানা।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুটি স্পষ্ট সাফল্য রয়েছে। প্রথমটি হলো দেশের প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসককে অপসারণ করা। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের পরে মনে হয়েছিল, এই স্বৈরশাসনের হয়তো পরিবর্তন হবে না। এতে সারা দেশে যে সামাজিক বিষণ্নতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। এখন দেশে পরিবর্তনের একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। এই জন–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরকারের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার সেটি প্রত্যাশিত মাত্রায় পেরে উঠছে না। বরং অভ্যুত্থানের পরে শহরজুড়ে যেসব দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে, সেখানেই অনেক স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে অভ্যুত্থানের প্রত্যাশাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় রকমের আয়বৈষম্য রয়েছে। এটা দূর করতে হবে। অর্থনৈতিক নীতিমালার সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে। বিদেশের সঙ্গে যেসব নীতিকৌশল হবে, সেগুলো বাংলায় লেখার বাধ্যবাধকতা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। আমরা ‘রিপাবলিকের’ বাংলা করেছি ‘প্রজাতন্ত্রী’। এটা ‘জনগণতন্ত্র’ হতে পারে।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ইদানীং আওয়ামী লীগ সন্দেহে অনেককে প্রহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ, নারী বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলে বা কাউকে সন্দেহ হলে তাদের শারীরিক আক্রমণ না করে এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুটি স্পষ্ট সাফল্য রয়েছে। প্রথমটি হলো দেশের প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসককে অপসারণ করা। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের পরে মনে হয়েছিল, এই স্বৈরশাসনের হয়তো পরিবর্তন হবে না। এতে সারা দেশে যে সামাজিক বিষণ্নতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেটে গেছে।
সংবিধানের মধ্যেই অনেক পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে উল্লেখ করেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘এসবের অপসারণ করতে হবে। আমাদের চিন্তার মধ্যেও ঔপনিবেশিক মানসিকতা রয়েছে।’
সলিমুল্লাহ খান বলেন, এখনো উচ্চ আদালতে বহু বিচারপতি বাংলায় রায় লিখতে পারেন না। তাঁদের অবশ্যই বাংলায় রায় লেখা উচিত। প্রয়োজন হলে কারা বাংলায় রায় লিখতে পারেন না, সরকার তাঁদের তালিকা করতে পারে। একই সঙ্গে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধনটিও আশু পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।
সংবিধান সংস্কারের পাশাপাশি অপশাসন দূর করার জন্য প্রশাসনের সংস্কার করে তাদের সরাসরি জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দান নিশ্চিত করতে হবে। যেমন অন্যের পাসপোর্ট দিয়ে কেউ বিদেশে যেতে পারে না বা একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য আরেকজন তুলতে পারে না, তেমনি ভোটদানের ক্ষেত্রেও এ রকম নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন সবার জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কঠিন হবে না। এটা করা গেলেই গণতন্ত্র অনেকটা নিশ্চিত হবে।
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, সংবিধান হবে সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত, যেন জনসাধারণ তা বুঝতে পারেন। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, এমন কোনো আইন সংসদে থাকতে পারবে না।
প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দান নিশ্চিত করতে হবে। যেমন অন্যের পাসপোর্ট দিয়ে কেউ বিদেশে যেতে পারে না বা একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য আরেকজন তুলতে পারে না, তেমনি ভোটদানের ক্ষেত্রেও এ রকম নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিগুলোর প্রতি সংশয় সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ এজ–এর সম্পাদক নূরুল কবীর। তিনি বলেন, তারা কী সংস্কার করছে, সে সংস্কার বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কতটা, এসব কেউ কিছু জানে না। অতীতে বরাবর জাতি প্রতারিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রী দল ছিল না। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে তারা সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। এই সরকার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। অথচ তারা সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বিভ্রান্তিমূলক অবস্থা তৈরি হয়েছে।
নূরুল কবীর বলেন, ‘এখনো আমরা নাগরিক হতে পারিনি, প্রজা হয়ে আছি। এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হবে। এখন প্রশ্ন তুলতে হবে—আমরা প্রজা হয়েই থাকব, নাকি নাগরিক হয়ে উঠব।’
অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোকে লাভ-ক্ষতির নিরিখে বিবেচনা করলে চলবে না। এগুলোকে অধিকার হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। কৌশলগত দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে মোশাহিদা সুলতানা বলেন, ‘চিনিকল, পাটকলগুলো লোকসান করছে বলে সেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু কেন এগুলো লোকসান করছে, তা দেখতে হবে। এগুলোর সঙ্গে লাভ–ক্ষতির বিষয় নয়, আমাদের জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের যুক্ততাকে বিবেচনা করে মূল্যায়ন করতে হবে। ভ্যাটের মতো বিভিন্ন প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রেও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করে অর্থনৈতিক সংস্কারের সুপারিশ করতে হবে।’
লেখক ও কলামিস্ট আলতাফ পারভেজ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও সংস্কার নিয়ে যেসব আলোচনা চলছে, তা শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে দেশের প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হবে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।