মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘রোহিঙ্গাদের চোখে জীবন’ আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু
‘দিন সপ্তাহে গড়ায়/ সপ্তাহগুলো হয় বছর/ বছর আসে এবং যায়/ কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা/ কখনো দূর হয় না’—কবিতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কথা এভাবেই তুলে ধরেছেন কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা তরুণ মো. মনসুর আলী। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মনের কথা উঠে এসেছে তাঁর এই পঙ্ক্তিমালায়। মনসুর আলীর তোলা রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবনের আলোকচিত্রের পাশে এই কবিতা প্রদর্শিত হচ্ছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৫ নম্বর গ্যালারিতে। আজ মঙ্গলবার সেখানে শুরু হয়েছে ‘রোহিঙ্গাদের চোখে জীবন’ নামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
আজ ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় রোহিঙ্গা আলোকচিত্রীদের তোলা আশ্রয়শিবিরের ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের আলোকচিত্র নিয়ে এ যৌথ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রদর্শনীতে রোহিঙ্গা আলোকচিত্রীদের তোলা ৫০টি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ১১টি—মোট ৬১টি আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনী চলবে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে প্রতি রোববার এবং ঈদুল আজহার সরকারি ছুটির দিনগুলোতে প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে।
রোহিঙ্গা শিবিরে বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী আছেন। তাঁরা ‘রোহিঙ্গাটোগ্রাফার ম্যাগাজিন’–এর ব্যানারে কাজ করছেন। তাঁদেরই ২০ জন আলোকচিত্রীর তোলা ছবি স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। সেগুলোতে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার নানা মুহূর্ত উঠে এসেছে।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাঈনুল কবির। তিনি বলেন, মানবিক কারণে মিয়ানমারের উদ্বাস্তুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রয়োজন। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। তা ছাড়া পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা বাড়ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তাও ক্রমেই কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিরাপদ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জাতিসংঘে আরও জোরালোভাবে উপস্থাপিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। আশ্রয়শিবিরে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
স্বাগত বক্তব্যে ইউএনএচইসিআরের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইয়োহানেস ভন ডার ক্লা-ও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, প্রথম দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য–সহযোগিতা পাওয়া যেত, কিন্তু এখন তা অনেক কমে এসেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা ও প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যেন তাদের দেশে নিরাপদে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ইয়োহানেস ভন ডার ক্লা বলেন, সারা বিশ্বেই শরণার্থী সমস্যা জটিল হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ, সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ—এসবের শিকার হয়ে প্রায় ১১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে আছেন। এর মধ্যে মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত আছেন।
প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী হিসেবে ভারতের আশ্রয়শিবিরে থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি জানান, তখন তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছর। খুলনার দাকোপে তাঁদের বাড়ি। সেখান থেকে মে মাসের ১৯ তারিখে সপরিবার যাত্রা শুরু করেন। সীমান্ত পার হয়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদে যান। সেখানে তিনি এবং তাঁর এক চাচাতো ভাই কলেরায় আক্রান্ত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এবং স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল।
শিশির মোড়ল বলেন, তাঁর প্রায় সমবয়সী বিভাস মারা যান। কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পরে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত, নিউ ব্যারাকপুর, রানাঘাট ও চাঁদপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে থেকেছেন। খাদ্যসহায়তা হিসেবে শুধু চাল-ডাল দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর তাঁরা দেশে ফেরেন। ওই সময় স্যালাইনের কাচের বোতলটি তিনি সঙ্গে নিয়ে এসে যত্নে রেখেছিলেন। সম্প্রতি সেটি নিদর্শন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সামিয়া তাবাসসুম, রোহিঙ্গা আলোকচিত্রী শাহাত জিয়া। সমাপনী বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা যাকের। সঞ্চালনা করেন ইউএনএইচসিআরএর বহিঃসম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী আয়েশা খানম।