এবারের বর্ষা: যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে...

রাজধানীতে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েছে পথচারীরা। আগারগাঁও, ৬০ ফিট, ঢাকা, ৩০ জুনছবি: আশরাফুল আলম

বাংলা সিনেমায় একটি গান আছে, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে/ মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে/ বাকিটা সময় যেন মরণ আমার...’ (মিতালী মুখার্জি ও ভুপিন্দর সিং, কথা: প্রদীপ গোস্বামী, সুর: আলাউদ্দীন আলী)। গানটি মনে হলো আষাঢ়ে বৃষ্টির হাল দেখে।

আষাঢ়, বৃষ্টি, বর্ষা—এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে নজরুলের ভাষায় বলতে হয় ‘মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি’, তাই তাকেই স্মরণ করতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও আসতে পারে মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কিংবা জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দের উদ্ধৃতি’। আসতে বাধা নেই কদম, কেয়া, খিচুড়ি আর শর্ষে ইলিশেরও। বর্ষায় এসবের কথা ভাবাই প্রসিদ্ধ রীতি। সেখানে বাংলা সিনেমার গানের উদ্ধৃতি হয়তো অনেকের কাছে খানিকটা বেখাপ্পা, এমনকি রুচিদূষণজনিত অভিযোগের সম্মুখীনও হতে পারে। কিন্তু এবার আষাঢ়ে বৃষ্টির অবস্থা দেখে এই গানই লাগসই বলে মনে হলো। যতক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছে, ততটা সময়ই একটু স্বস্তি ফিরছে জীবনে আর বর্ষণ বন্ধ হলে আবার সেই রূঢ় রোদ্দুর। জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা অসহ্য গরম-গুমোট।

এভাবেই আষাঢ় মাসের আধাআধি পেরিয়ে গেল। আজ রোববার ষোড়শ দিবস। বৃষ্টি যে মাঝেমধ্যে হচ্ছে না, তা নয়। তদুপরি আষাঢ়কে আষাঢ়ের মতো করে পাওয়া গেল না এখন অবধি। অবশিষ্ট আর যে কয় দিন আছে, তাতে অবশ্য বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া বিভাগ। আগামী পাঁচ দিনই ঢাকাসহ রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী বিভাগসহ দেশের প্রায় অধিকাংশ জেলাতেই বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সক্রিয় রয়েছে মৌসুমি বায়ু। কাজেই বৃষ্টি হবে, তা আশা করাই যায়। কিন্তু এই যে ভয়ানক গরম, বৃষ্টি হলেও হার না মানা উত্তাপ, তার কি কোনো হেরফের হবে আদৌ? খুব বেশি ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।

আবহাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যা–ই হোক না কেন, এ বছর গ্রীষ্মও এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে প্রখর তাপ প্রাণ হানিকর হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেল, চিকিৎসার ভাষায় ‘হিট স্ট্রোক’–এ এবারের গ্রীষ্মে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩৫ জন, এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। গরমকালের সেই তাপ যাচ্ছে না বর্ষাতেও। বৃষ্টি যখন নামছে, তখন চারপাশ খানিকটা কোমল হয়ে এলেও হাওয়া উত্তপ্ত হতে খুব বেশি সময় লাগছে না। আবার সেই হাঁসফাঁস করা গরম-গুমোট। পথে বের হলে ঘর্মাক্ত কলেবর। ঘরে-বাইরে স্বস্তি নেই কোথাও।

উত্তাপ কেন কমছে না? তন্দুর হয়ে ওঠা ধরণিতলকে সুশীতল করতে পারছে না কেন অমিয় বারিধারা? পরাজিত হয়ে গেল কি বর্ষা তবে? সহজ দৃষ্টিতে এমন মনে হওয়া আশ্চর্যজনক নয়। আষাঢ়ের মেঘ যতই হাঁকডাক ছাড়ুক, গায়ের জ্বালা জুড়াচ্ছে না, এটাই হলো মোদ্দাকথা। আজ রোববার আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানালেন, এবার বর্ষায় ঢাকায় বৃষ্টি একটু কম, তবে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু বাড়তিই বর্ষণ হয়েছে। ঢাকায় আজকের উত্তাপ ৩১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশেই তাপমাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। তবে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকার জন্য। আজ বাতাসের আর্দ্রতা ৮৩ শতাংশ।

শাহীনুল ইসলাম বললেন, ‘বরাবরই আমাদের দেশের আবহাওয়ায় জলীয় বাষ্পের প্রাধান্য থাকে। এ জন্য আবহাওয়ার পরিভাষায় “হিউমিড ওয়েদার” বলা হয়। এ কারণেই বাইরে গেলে বা একটু শারীরিক পরিশ্রম করলে প্রচুর ঘাম হচ্ছে, অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।’

দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং আবহাওয়া নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে আজ বলা হয়েছে, আগে যেখানে এপ্রিল মাস ছিল দেশের সবচেয়ে উষ্ণ মাস, এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রীষ্মকালের মেয়াদ বাড়তে বাড়তে তা বর্ষাকে ছাপিয়ে প্রায় হেমন্তের কাছাকাছি চলে গেছে। তাপপ্রবাহ বাড়ছে। তাপপ্রবাহ এখন সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় উত্তাপ একটু করে বাড়ছে। গত তিন দশকে ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তাপমাত্রা যা ছিল, তার পর থেকে ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। তাপপ্রবাহের পাশাপাশি খরা বাড়ছে, বৃষ্টিপাত হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে ঘন ঘন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে। সব মিলিয়ে ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে শীর্ষে।

পরিবেশবিদেরা বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ খুঁজতে গিয়ে এল নিনো, লা নিনো—এমন অনেকর রকম বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাঁরা বলেছেন অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড়সহ অনেক কারণের কথা। সতর্কবাণী তাঁরা অনেক আগে থেকেই দিয়ে যাচ্ছেন। কে আর ওসবে কান পাততে যায়? ফলে যা হওয়ার, তা–ই। বর্ষার আকাশেও আর দেখা যাচ্ছে না সেই ধূমল মেঘ, রবীন্দ্রনাথ যাকে দেখে একদা লিখেছিলেন ‘ঝুঁটি-বাঁধা ডাকাত সেজে/ দল বেঁধে মেঘ চলেছে যে/ আজকে সারাবেলা।/ কালো ঝাঁপির মধ্যে ভরে/ সুর্যিকে নেয় চুরি করে,/ ভয়-দেখাবার খেলা।’, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে...’ অথবা ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহি রে।’—এমন অনন্য পঙ্‌ক্তিমালা। সেই মেঘ প্রায় উধাও হয়েছে বর্ষা থেকে। নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যেন সেই বর্ষাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হায়! বর্ষাও এখন গ্রীষ্মের মতো তপ্ত!

প্রকৃতিকে তার আপন স্বভাবে পাওয়া না গেলে কেবল মানুষই নয়, জীবকুলের পক্ষেই প্রাণ ধারণ করে চলা অসহনীয় হয়ে পড়ে। প্রকৃতির এই পালাবদল একনিমেষে, একঝটকায় ঘটে যায় না এবং তা শিগগিরই প্রতিভাত হয় না, নিয়মিত ও ধীর বলে। পরিবেশের ক্ষেত্রে অধুনা ‘অভিযোজন’, ‘খাপ খাইয়ে নেওয়া’—এসব কথার খুব চল। খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি বলে ‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে’ এবং অভিযোজনে কামিয়াব হওয়ায় ‘তেলাপোকাটি টিকিয়া আছে’। কিন্তু মানুষের পক্ষে শুধু টিকে থাকাটাই কি যথেষ্ট? এই প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব হবে—‘না’।

মানুষ তার জীবনের সার্থকতার প্রত্যাশা ও অন্বেষণ করে। জীবনকে উপভোগ করতে চাওয়া তার বিশেষ কামনা ও স্বভাব। সে কারণে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা ছাড়াও তার আরও অনেক কিছু প্রয়োজন। বসন্তকে বসন্তের মতো, বর্ষাকে বর্ষার মতো করে পেতে ইচ্ছা হয়। তুমুল বৃষ্টির দিনে শুনতে ইচ্ছা করে, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন....।’ এসব না পেলেই অস্বস্তি, অসুখ। ঋতুকে তার আপন স্বভাবে না পাওয়ার মতো অনেক কিছুই আজ আমাদের অসুখী করে তুলেছে। কেন যেন মনে পড়ছে জীবনানন্দ দাশকে, ‘সুচেতনা...পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন...।’