সাফাত নাবিল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে প্রতিদিন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যেতেন। যানজটে পড়ে তাঁর অনেকটা সময় রাস্তায় নষ্ট হতো। যানজট এড়িয়ে কীভাবে, কোন পথে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি।
এমন ভাবনা থেকে নাবিল ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে ফেলেন। গ্রুপটির নাম ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’। যানজট এড়িয়ে কিছুটা সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট গ্রুপটির যাত্রা শুরু হয়।
শুরুতে ঢাকার কোন রাস্তায় যানজট বেশি, কোন রাস্তায় কম, কোন পথে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে—এসব তথ্য গ্রুপে আদান-প্রদান করেন সদস্যরা। এখন গ্রুপটিতে ঢাকার যানজট ছাড়া ট্রাফিক-সংক্রান্ত নানা ধরনের তথ্যও আদান-প্রদান করা হচ্ছে। অবৈধ পার্কিং থেকে শুরু করে বিআরটিএতে গাড়ির কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণসহ নানা বিষয়ে এই গ্রুপের সদস্যরা সাহায্য চাইছেন। গ্রুপের মাধ্যমেই তাঁরা সমাধান পেয়ে যাচ্ছেন।
প্রথম দিকে গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ছিল সীমিত। এখন তা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রুপের এসব সদস্যই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রতিমুহূর্তে সড়কের হাল জানিয়ে দিচ্ছেন।
গ্রুপ পরিচালনাকারীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। তখন ঢাকার মানুষ বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সড়কের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মূলত তখন থেকেই ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপের সদস্য বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিন গ্রুপে ৩০০ থেকে ৫০০ পোস্ট আসে। নতুন সদস্য হতে অনুরোধ আসে কয়েক শ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সানি ইসনাইন ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপের পুরোনো সদস্য। তিনি নিয়মিত এই গ্রুপে তথ্য আদান-প্রদান করেন। সানি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপে ঢুঁ মারি। গ্রুপে রাস্তার অবস্থাসম্পর্কিত তথ্য দেখে বের হই। কোন পথ দিয়ে গেলে যানজট কম পড়বে, সেই তথ্য পেতে গ্রুপটি আমাকে সাহায্য করে।’
ঢাকার সড়কে যানজট বা দুর্ঘটনার খবরাখবর অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপে আগে চলে আসে। যেমন গত ১৫ আগস্ট উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার চাপায় একটি প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহী নিহত হন। গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত খবর আসার আগেই দুর্ঘটনার একটি ছবি ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপে একজন পোস্ট করেন। পরে সেই ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা নাবিল প্রথম আলোকে বলেন, যানজট কম—এমন বিকল্প পথে ঢাকাবাসীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তার লক্ষ্য নিয়েই ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপটি খোলা হয়। প্রথম দিকে গ্রুপের সদস্যরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যানজটসম্পর্কিত পোস্ট দেন। এখন যানজট পরিস্থিতির পাশাপাশি সড়কে ভিআইপি চলাচল, দুর্ঘটনা, অবৈধ পার্কিংসহ নানা ধরনের পোস্ট আসে। পোস্টের মাধ্যমে একজন অন্যজনকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন।
রাজধানীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপে বর্তমানে সব বয়সী সদস্য রয়েছেন। তবে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী সদস্যের সংখ্যা বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী শিরিন আকতার প্রতিদিন গুলশানের বাসা থেকে মিরপুরে যাতায়াত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপটা একটা বড় কমিউনিটি হয়ে উঠেছে। ঢাকার রাস্তায় বের হলে যাতায়াতে সহায়তা করবে—এমন সব তথ্যই এখানে পাওয়া যায়।
বর্তমানে ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপের পরিচালনাকারী আছেন পাঁচজন। পাশাপাশি একই নামে পরিচালিত ফেসবুক পেজের তিন পরিচালনাকারীও এই গ্রুপ পরিচালনায় সাহায্য করেন। এই আটজনই বন্ধু ও পরিবারের সদস্য। তাঁরা নিজেদের কাজের ফাঁকে গ্রুপটি পরিচালনা করেন। কাজের সুবিধার্থে তাঁরা সময় ভাগ করে নিয়েছেন।
গ্রুপ পরিচালনাকারীরা বলেন, গ্রুপের কিছু নিয়মকানুন আছে। সদস্যদের সেগুলো মানতে হয়। না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রুপে প্রচুর পোস্ট আর কমেন্ট আসে। সেগুলো নিয়মিত দেখভালের চেষ্টা করেন তাঁরা। তবে দিন দিন পোস্ট-কমেন্টের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা সামাল দিতে তাঁদের হিমশিম খেতে হয়।
ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, যানজটের সমস্যা থেকে রাজধানীবাসীর আশু মুক্তির লক্ষণ নেই। তাই যানজট যতটা এড়িয়ে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা যায়, সেই চেষ্টাই সবাই করেন। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) মো. শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যানজট এড়াতে অনেকেই ট্রাফিক অ্যালার্ট গ্রুপটি অনুসরণ করেন। ট্রাফিক সচেতনতায় যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রাফিক-সংক্রান্ত যেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে, সেগুলোকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনা হবে।