গণ–আন্দোলনের শিল্পভাষ্য

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘শরীর ও মানচিত্র’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন দর্শকেরাছবি: সাজিদ হোসেন

মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করে। দাবিদাওয়া আদায়ের সংগ্রামে নামে। এর অনেক রকমের প্রকাশভঙ্গি ও উপায় আছে। তবে নিজের শরীরও যে একটি কালজয়ী পোস্টার হতে পারে, শহীদ নূর হোসেন সেই নজির সৃষ্টি করেছিলেন গত শতকের নব্বইয়ে স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামে। এবার চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে যাঁরা রাজপথ কাঁপিয়েছেন, অকুতোভয়ে উদ্যত বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের শরীর আর কেবল রক্তমাংসের শরীরের মধ্যে সীমিত থাকেনি। মানবদেহ আর দেশের মানচিত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অন্তত দেশের তরুণ শিল্পসাধকদের কাছে এমনই অনুভূত হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল শিল্পালয়ে তরুণ শিল্পীদের যে দলবদ্ধ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী চলছে, সেখানে তাঁরা তাঁদের এই অনুভবের কথাই ব্যক্ত করেছেন শিল্পকলায়। সে কারণে প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন ‘শরীর ও মানচিত্র’।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে এ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে মূল্যায়ন করেছে খ্যাতনামা ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট। সর্বজন স্বীকৃতি দিয়েছেন, এই ঘটনা আমাদের দেশের ইতিহাস এমন করে বদলে দিয়েছে, যার নজির ১৯৭১–এর পরে আর দ্বিতীয়টি নেই। রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব তো রয়েছেই, গণমানুষের মনোজগতে, চিন্তা, মনন ও সৃজনশীলতায় গভীর অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এই অভ্যুত্থানকে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতিতে স্থায়ীভাবে সঞ্চিত করে রাখারও বিবিধ প্রয়াস চলছে। তরুণ শিল্পীদের এই শিল্পকর্ম প্রদর্শনী সেই কর্মপ্রবাহেরই একটি নান্দনিক সংযোজনা।

প্রদর্শনীর জন্য ১০ জন শিল্পী বহু মাধ্যমে, অজস্র উপকরণ ব্যবহার করে অভিনব ভাবনায় গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তাঁদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এত এত রকমের কাজের সম্ভার সেখানে উপস্থাপিত হয়েছে যে সবকিছুর মোটামুটি বিবরণও এই সীমিত পরিসরে দেওয়া অসম্ভব। তবে সবার কাজের মধ্যেই একটি অন্তর্গত ঐক্যের জায়গা রয়েছে, তা হলো গণ-আন্দোলনের শৈল্পিক অভিব্যক্তির ভাষ্য রচনা করা।

প্রদর্শনীতে ঢুকেই চোখের সামনে দেয়ালজুড়ে ক্যানভাসে দেখা যাবে হাঁটুর নিচ অবধি পা। সেখান থেকে রক্তধারা চুইয়ে পড়ছে। পাশেই একটি মানুষের পিঠের বড় আকারের দৃশ্য। তাতে বিঁধে আছে অসংখ্য বুলেট। এবার গণ-অভ্যুত্থানের খুব চেনা এসব দৃশ্য খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের পর্দায় অনবরত দেখেছেন দেশ-বিদেশের মানুষ। নিরস্ত্র ছাত্র–জনতাকে পর্যুদস্ত করতে গিয়ে কী নির্মমভাবে তাঁদের ওপরে গুলি চালানো হয়েছিল, এই শিল্পকর্ম তারই নান্দনিক বয়ান। রক্তাক্ত পা এঁকেছেন ফারজানা আহমেদ ঊর্মি আর গুলিবিদ্ধ পিঠের ছবিটি রাজীব দত্তের আঁকা। এই চিত্রকলার ডান পাশেই আছে অনেক রকমের খেলনা দিয়ে তৈরি একটি স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটির চূড়ায় আছে খুব ছোট্ট একটি সুন্দর পুতুল। শিশু রিয়া মণি ঘরের মধ্যে শহীদ হয়েছিল গুলিতে। তার স্মরণেই হৃদয়ে মোচড় দেওয়া এই শিল্পকর্মটি আফসানা শারমিনের।

এ এসেন রাখাইন ছাপচিত্রে তুলে ধরেছেন মানুষ কীভাবে ভীতসন্ত্রস্ত সময় পার করেছে গত দশকগুলোতে। রিপন সাহার ছবিগুলো অভিনব। মানুষের শরীরে মাথার জায়গায় হাতের পাঞ্জা। আঙুলগুলো বিভিন্ন ইশারা ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমরা যেমন বলে থাকি ‘নেপথ্যে কার আঙুলের ইশারায় এসব কাজ হচ্ছে’ অনেকটা সে রকম ব্যাপারকে তুলে ধরেছেন তিনি।

পলাশ ভট্টাচার্যের কাজে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে মানুষের ভাব-ভাবনা প্রকাশের জায়গা হয়ে উঠেছিল এবং একটা পর্যায়ে গণ–আন্দোলন দমন করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এই বিষয়গুলো। আসাং মং রাখাইন ত্রিমাত্রিক কাজ করেছেন। মানুষের হাতবিশিষ্ট বিরাট পাখির অবয়ব ঝুলছে ছাদ থেকে। যেন সবকিছু সেই সফেদ বর্ণের পাখি আঁকড়ে ধরতে চাইছে তার প্রসারিত থাবার ভেতরে।

নিয়াজ উদ্দিন আহম্মদ এঁকেছেন পিচঢালা রাজপথে রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে, বৃষ্টির ধারায় ভিজছে রাজপথ, তার মধ্যে দিয়েই আবার উঠে আসছে প্রতিবাদ, বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা। বিশাল ক্যানভাসে মং মং সে এঁকেছেন মানুষের ওপর জুলুম–নির্যাতনের এক মর্মস্পর্শী বাস্তবধর্মী চিত্ররূপ। রাসেল রানা তৈরি করেছেন অনেকগুলো মানবদেহ। সেগুলোতে নির্যাতনের চিহ্ন। ছাদ থেকে ঝুলছে দেহগুলো। দেখেই আয়নাঘরে নির্যাতনের কথা মনে পড়ে।

প্রত্যেক শিল্পীই বিভিন্ন মাধ্যমে একাধিক কাজ করেছেন। তাঁদের অ্যাক্রিলিক, জলরং, ছাপচিত্র, মিশ্র মাধ্যম, ভিডিও, স্থাপনা, ভাস্কর্য, ডিজিটাল প্রিন্টসহ অনেক মাধ্যমের কাজের এই বৈচিত্র্যময় সমারোহ উপস্থাপনের দায়িত্বটি পালন করেছেন প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্প সমালোচক শার্মিলি রহমান। তিনি বললেন, ‘এই প্রদর্শনী আমাদের সঙ্গে সময় ও দৈনন্দিন পরিস্থিতির বোঝাপড়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরার প্রয়াস। শিল্পীরা প্রথাগত কাঠামো ও পদ্ধতির পাশাপাশি নিজেদের শিল্পচেতনায় এই অভ্যুত্থানকে প্রতিবাদ, নির্যাতন, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন।’

আমাদের সময়ের বিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনার নান্দনিক ভাষ্য এই প্রদর্শনী। এটি চলবে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটার মধ্যে এলে আন্দোলনের শিল্পরূপ উপলব্ধির সুযোগ পাবেন দর্শকেরা।