শব্দ, বায়ুদূষণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে বর্ষবরণের রাত
বছরের এই সময়ে আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক থাকে। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার আকাশ ছিল ছেঁড়া মেঘে ঢাকা। দৃষ্টিসীমাজুড়ে ছিল বেশ কুয়াশাও। আজ শুক্রবার সকাল থেকে আকাশ থেকে মেঘ সরে গেছে। বাতাসে জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে আর রোদে উষ্ণতা ফিরে শুষ্কভাব ফিরে এসেছে। কিছুটা কমেছে বায়ুদূষণ।
তবে গত তিন বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাতের বায়ুমানের রেকর্ড বলছে, রাত ১১টা–১২টার পর বায়ুর মান দ্রুত খারাপ হতে থাকে। এ সময়ে শব্দদূষণও সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যায়। বর্ষবরণ উদ্যাপন করতে গিয়ে নগরবাসী যে আতশবাজি পোড়ায় আর পটকা ফোটায়, তার ফলাফল শব্দ ও বায়ুদূষণের ভীষণ অবনতি।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) তিন বছর ধরে ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়ের বায়ু ও শব্দদূষণের বিষয়টি মাপছে। তাতে দেখা গেছে, বর্ষবরণের উৎসব করতে গিয়ে ঢাকাবাসী বায়ু ও শব্দের মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছেন। জরিপে দেখা গেছে, গত তিন বছর গড়পড়তা এক দিনের ব্যবধানে শব্দদূষণ বেড়েছে ৯৩ শতাংশ। আর বায়ুদূষণ বেড়েছে ৩৩ শতাংশ; যা দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বায়ুদূষণের মানমাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি।
এ বিষয়ে ক্যাপসের পরিচালক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষবরণ করতে গিয়ে শব্দ ও বায়ুদূষণ ঘটানো দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। একই সঙ্গে তা নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা দূষণের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বেশি থাকেন অর্থাৎ বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের বিপদ আরও বাড়িয়ে দেবে।
ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বর্ষবরণের রাতে বায়ু ও শব্দদূষণের তীব্রতা বেড়ে গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এর কারণ হিসেবে অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বিকেল পাঁচটা থেকে কোনো ধরনের মোবাইল কোর্ট বা এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালানোর নিয়ম নেই। এ ছাড়া তাদের এনফোর্সমেন্ট করার মতো ম্যাজিস্ট্রেট আছেন মাত্র তিনজন। এ অবস্থায় একদিকে আইনি সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে জনবলের অভাবে তাঁরা এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বর্ষবরণের রাতে এভাবে বায়ুদূষণের বিষয়টি তাঁদের নজরে এসেছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে তিনি জানাবেন।
বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি
গত কয়েক বছর ধরে বর্ষবরণ উদ্যাপনে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হয়েছে শহরের বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ফানুস ওড়ানো। রাতের আঁধারে হাজার হাজার ফানুস দৃষ্টিসীমাজুড়ে নান্দনিক আবহ তৈরি করলেও রাজধানীতে বড় ধরনের অগ্নি দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। কারণ, এই সময়টাতে এমনিতেই আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। আবার রাজধানীর উন্মুক্ত স্থানে থাকা বিদ্যুতের তারে গিয়ে ফানুস পড়লেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম থাকায় সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আরও বেশি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীতের এই সময় আবহাওয়া ও নগরের অবকাঠামো শুষ্ক থাকায় এমনিতেই অগ্নিঝুঁকি বেশি থাকে। আর আমরা যদি আনন্দের নামে এভাবে ফানুস উড়িয়ে এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিই, তা কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।’
শীতের শুষ্ক মৌসুমে নির্মাণকাজের ধুলা, যানবাহন আর ইটভাটা থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর কারণে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর থেকে আরও বেশি বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়।
বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ বলছে, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা পর্যন্ত রাজধানীর বায়ুর মানের সূচক ছিল ১৪০ থেকে ১৭০–এর মধ্যে; যা এই সময়ের স্বাভাবিক বায়ুমানের চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে তা অস্বাস্থ্যকর। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান বায়ুদূষণের দিক থেকে ছিল ১৫ থেকে ২৫–এর মধ্যে। শীর্ষ তিনে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, ভারতের দিল্লি ও সার্বিয়ার বেলগ্রেড।