‘মায়েদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা দেখলে কষ্ট হয়, তাই মেয়েকে নিয়ে মার্কেটে যাইনি’
মাসখানেক আগে স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরার পথে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা রাফিকা পাঠান। তাঁর এভাবে চলে যাওয়া বড় দাগ কেটেছে মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মারিয়াম রুহির মনে। স্ত্রী হারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি মারিয়াম রুহির বাবা আবু সুফিয়ান।
তাই ঈদে এখনো মেয়ের নতুন পোশাক কেনা হয়নি তাঁর। ঈদ উপলক্ষে স্বজনেরা আমন্ত্রণ জানালেও সেখানে যেতে রাজি নন তিনি। ভয়, অন্য শিশুদের বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখলে মেয়ে যদি মন খারাপ করে!
আজ শনিবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘মার্কেটে মানুষ দেখলে, মায়েদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা দেখলে কষ্ট হয়। সহ্য করতে পারি না। তাই মেয়েকে নিয়ে যাইনি।’
মারিয়াম রুহি পড়ে টিকাটুলির কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে। গত ২৮ মার্চ স্কুল ছুটির পর মেয়েকে নিয়ে রিকশায় করে বাসার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন রাফিকা পাঠান। ওয়ারীর শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সামনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।
মায়ের ওই দুর্ঘটনা ভুলতে পারছে না মারিয়াম রুহি। আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে জানান, ‘মেয়েটা মোবাইলে শুধু দুর্ঘটনার ভিডিও দেখে। আর কিছু দেখে না। ওর মায়ের সঙ্গে মিলে যায়। অন্য ভিডিও দিলে কান্নাকাটি শুরু করে। ও শুধু দুর্ঘটনার ভিডিওই দেখতে চায়।’
ওই দিনের ঘটনা এখনো মনে আছে মারিয়াম রুহির। মেয়েটি বলে, ‘বাসায় আসার সময় বাসটা ফুটপাত ঘেঁষে দূর থেকে আসছিল। তখন সেটির ধাক্কায় পড়ে যাই। মা ও রিকশাকে তছনছ করে দিয়ে যায় (বাসটি)।’
মাকে মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে জানিয়ে শিশুটি বলে, ‘ঘুমালে আম্মুকে স্বপ্ন দেখি।’
এই শোক থেকে মেয়েকে ভুলিয়ে রাখতে ঈদ সামনে রেখে সাভারের চন্দ্রায় ছোট ভাইয়ের বাসায় গেছেন সুফিয়ান। তবে মেয়েকে নিয়ে এখনো স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘ঈদে সবার মা তাঁর কন্যাকে সাজিয়ে দেবে। ওকে (রুহি) তো ওর মা সাজাতে পারবে না। অনেকেই বলেছেন তাঁদের সঙ্গে ঈদ করতে। (সেসব শিশুকে দেখলে) সেটা ও তো সহ্য করতে পারবে না, আমি সহ্য করতে পারব না।’ ঈদের দিন মেয়েকে ফ্যান্টাসি কিংডমে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
স্ত্রী ও এই মেয়েকেই নিয়ে ছিল আবু সুফিয়ানের সংসার। বাসায় গৃহকর্মী থাকলেও এখন আর চলছে না। সে কারণে নিজের মাকে তিনি বাসায় নিয়ে এসেছেন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে মারিয়াম রুহির খাওয়া অর্ধেকে নেমেছে বলে জানান বাবা। আবু সুফিয়ান বলেন, ‘ওকে খাইয়ে দিতে হয়। ও আমাদের সঙ্গে খেতো না। ওর মা ওকে আলাদা করে খাওয়াত, ঝাল কম দিয়ে। কাজের লোকেদের রান্না করা খাবার সে খেতে পারে না।’
এখন দাদির হাতের রান্না অল্প অল্প করে খাচ্ছে মারিয়াম রুহি। তবে দাদির উপস্থিতিও তাকে এখনো মা হারানোর দুঃখ ভোলাতে পারেনি। শিশুটি সারা দিন চুপচাপ থাকে। যখন পড়তে-লিখতে বসে, তখন কলম কামড়ে চিন্তা করতে থাকে। বাবা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘রুহি বলে, যদি স্কুলে না যেতাম, তাহলে মা আনতে যেত না। তাহলে মা মারাও যেত না!’