গতকাল মঙ্গলবার দিনের বেলায়ও ছয়জনের পরিবার ছিল নার্গিস বেগমের। আজ বুধবার সেই পরিবার পাঁচজনের। নাই হয়ে গেছেন নাহিদ হোসেন। ২০ বছর বয়সী এই ছেলের রোজগার দিয়ে চলত সংসারটি। পরিবারটির কাছে শোকের পাশাপাশি এখন বড় প্রশ্ন, সংসার চলবে কীভাবে। এ হত্যার বিচার চান না তাঁরা। কারণ, মামলা চালানোর টাকা তাঁদের নেই।
গতকাল রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকানমালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান নাহিদ। তিনি ডি-লিংক নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ‘ডেলিভারিম্যান’ ছিলেন। নাহিদের বাসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রনি মার্কেটের মেম্বার গলিতে।ওই দিন সকাল ১০টায় কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। দুপুরে নিউমার্কেট এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাথায় আঘাত পান নাহিদ। রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
গলির ভেতরে একটু এগোতেই হাতের ডান পাশে নাহিদদের বাড়িটা। আধা কাঠা জমির ওপর বাড়ির কাঠামোটি। দেড় হাত প্রশস্ত চিকন সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ঘর। এ ঘরে থাকেন বাবা নাদিম হোসেন, মা নার্গিস এবং ছোট দুই ভাই শরীফ ও ইব্রাহিম। আর তৃতীয় তলায় টিনশেডের ঘরে থাকতেন নাহিদ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী ডালিয়া। পুরো বাড়ির কাঠামো তৈরি হয়েছে কেবল। পলেস্তারা হয়নি, চুনকামও হয়নি। ঘরের কাজ এখনো অনেক বাকি। ধীরে ধীরে বাড়ি-সংসার সাজানোর কথা ছিল নাহিদের।
নাহিদকে হারিয়ে সেই বাড়ির পরিবেশ এখন আহাজারিতে ভারী। বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী। কেউ সমবেদনা, কেউ সান্ত্বনা জানাচ্ছেন। তাঁরা বলছিলেন, দুই পক্ষের মারামারিতে পড়ে নিরীহ একটা ছেলের প্রাণ গেল। এটা কেমন বিচার? ছেলে হারিয়ে শোকাহত মা নার্গিস বলেন, ‘আমরা বিচার চাই না। নাহিদকে তো আর ফেরত পাব না। বিচার চেয়ে কী হবে। বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলব।’
মামলা করবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা চালাতে টাকাপয়সা লাগে। এগুলো করে লড়তে পারব না। মামলা করে কী করমু। এগুলো করলে কি আমার ছেলে ফেরত আসবে? অত্যাচারটা করে আমার ছেলেকে মারা হলো। আমার যা যাওয়ার চলে গেছে।’
নাহিদরা তিন ভাই। নাহিদ সবার বড়। মেজ ছেলে শরীফের বয়স সাত বছর ও ছোট ছেলে ইব্রাহিমের বয়স তিন বছর। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন নাহিদ। এরপর আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে লেখাপড়া আর এগোয়নি। পরিবারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়েন নাহিদ। সাত হাজার টাকা বেতনে গত দুই বছর কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন।
বেতনের পুরো টাকাই সংসারে দিতেন বলে জানান নাহিদের মা। নিজে থেকেই ছেলের কথা বলছিলেন আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। নাহিদের মা বলেন, ‘নাহিদের বাবা একটা কোম্পানিতে কাজ করে অল্প কিছু টাকা পায়। এটা দিয়ে ঋণ শোধ করতে হয়। আর সংসার চালাত আমার ছেলে নাহিদ।’
পরিবারের সদস্যরা জানান, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নাহিদ ও ডালিয়ার বিয়ে পারিবারিকভাবেই হয়। ডালিয়াদের বাসা লালবাগের আমলীগোলায়। ডালিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আমাদের বিয়ে হয়। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। আর সে (নাহিদ) মারাও গেল মঙ্গলবারে। রাতে সাহ্রিতে মাংস রান্না হয়েছিল। নাহিদ মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিল। রোজামুখেই নাহিদ মারা গেল।’
১৮ বছর বয়সী ডালিয়া বলেন, ‘নিজের জন্য নাহিদ কিছু কিনতে চাইত না। একটা শার্ট, প্যান্ট, জুতা কিনত না। খালি আমার লাইগা কেনাকাটা করত। আমার কোনটা লাগবে, কোনটা প্রয়োজন, সব আমাকে নিয়েই করত। এখন আমাকে কে দেখবে, আমাকে কে ভরসা দেবে। সরকার কি আমাদের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে? কে নিবে আমার দায়িত্ব।’
নাহিদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় চোখে পড়ল ডালিয়ার দুই হাতভরা রাঙা মেহেদির নকশা। বাঁ হাতের তালুতে মেহেদি রঙে ইংরেজিতে লেখা, ‘আই লাভ ইউ নাহিদ।’ নাহিদের স্ত্রী সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘নাহিদ চলে গেল কিন্তু রেখে গেল ভালোবাসা।’
আজ বুধবার দুপুরে নাহিদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে কামরাঙ্গীরচরের বাসায় নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে বিকেলে তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।