পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

সংঘর্ষ শুরুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে যান পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ছাত্রদের, ব্যবসায়ীরাও অসন্তুষ্ট।

সংঘর্ষ থামাতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছেন পুলিশের এক সদস্য
ছবি: প্রথম আলো

সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে ছিল দুই পক্ষ। কিছুক্ষণ পরপরই চলছিল পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। একদিকে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা, অন্যদিকে কলেজের আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকানমালিক-কর্মী ও ফুটপাতের হকাররা। একপর্যায়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। ঘটনাস্থল রাজধানীর মিরপুর সড়কের নীলক্ষেত মোড় থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের মাঝখানের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা। ঘটনাস্থলের এক প্রান্তে নীলক্ষেত পুলিশ বক্স, অন্য প্রান্তে সায়েন্স ল্যাব পুলিশ বক্স।

শুধু এই দুটি পুলিশ বক্সই নয়, ঘটনাস্থলের কাছেই নিউমার্কেট থানা। অথচ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এল সংঘর্ষ শুরুর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর। ততক্ষণে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ইতিমধ্যে ইট ও লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন সাংবাদিক, পথচারী, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ অন্তত ৪০ জন। পুলিশ কেন ঘটনাস্থলে এত দেরিতে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন, তা নিয়েও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

গত সোমবার রাতেও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার বিপণিবিতানগুলোর ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই রাতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। গভীর রাতে সংঘর্ষ থেমে গেলেও পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মঙ্গলবারও কিছু একটা ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কা ছিল। এরপরও পুলিশ কেন আগাম ব্যবস্থা নেয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুর সড়কে শুরু হওয়া সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতেও সেখানকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে।

যেখানে সংঘর্ষ হয়েছে, তা পুলিশের রমনা বিভাগের আওতাধীন এলাকা। সংঘর্ষ শুরুর পর ঘটনাস্থলে আসতে পুলিশের এত দেরি হলো কেন, এমন প্রশ্নে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলের আশপাশেই ছিলাম, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’

পুলিশ সময়মতো ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না বলে নিউমার্কেট এলাকার আট-নয়জন দোকানমালিক প্রথম আলোকে বলেছেন। এ বিষয়ে পুলিশের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশের সময়, পুলিশ বুঝবে।’ এ নিয়ে আর কথা বলতে চাননি তিনি।

এদিকে সংঘর্ষের সময় পুলিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের দাবি, সোমবার রাতেও ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়েছিল পুলিশ। আর গতকাল দুপুরের পর ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছে পুলিশ। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়া হয়েছে।

ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া শিক্ষার্থী ফুয়াদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে গুলি করেছে। ঘটনাস্থলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত থাকার পরও পুলিশ বুলেট নিক্ষেপ করেছে। পাঁচজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁরা সবাই সাধারণ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে যেসব রাবার বুলেট ছোড়া হয়েছে, সেগুলোর খোসা সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেও প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি। ছাত্রদের থামাতে পুলিশের ভূমিকা ছিল না। নিউমার্কেটের উল্টো দিকের বিপণিবিতান চন্দ্রিমা মার্কেটের ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান দাবি করেন, ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের নূরজাহান মার্কেটের একটি দোকানে সকালে আগুন দিয়েছিলেন কয়েকজন ছাত্র। এরপর চন্দ্রিমা মার্কেটেও আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের ওপর কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু পুলিশ এসব থামাতে সময়মতো আসেনি। আবার আসার পরও তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নেয়নি।

আর দুপুর পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে কেন ঢুকতে পারেনি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম।

দেরিতে ঘটনাস্থলে পুলিশ যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল রাতে প্রথম
আলো
কে বলেন, ‘এটা স্ট্র্যাটেজির (পরিকল্পনা) অংশ ছিল। ব্যবসায়ী নেতা, কলেজের ছাত্র-শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ
করেছিলেন। অন্যদিকে ছাত্ররা ঢাকা কলেজের ১০ তলা ভবনের ছাদে ইটপাটকেল নিয়ে অবস্থান নেন। পুলিশ সেখানে গেলেই ওপর থেকে ছাত্রদের ইটপাটকেলের হামলার শিকার হতো। তখন পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হতো। ওই পরিস্থিতি পুলিশ এড়াতে চেয়েছিল। দোকান মালিক সমিতি ও তাদের কর্মচারীদের এবং ছাত্রনেতারা ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সরাতে ব্যর্থ হওয়ার পর পুলিশ অ্যাকশনে গেছে।

পুলিশ পরিস্থিতি সময়মতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় গতকাল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এর প্রভাবে আশপাশের বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট ছড়িয়ে পড়ে। দিনভর সড়কে ভোগান্তির শিকার হন হাজারো মানুষ।

সোমবার দিবাগত রাত ও গতকাল মঙ্গলবার দিনভর সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটল, সেখানে পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারির অভাব ছিল বলে মনে করেন এই বাহিনীর সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেছুর রহমান। গতকাল রাতে টেলিফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট এলাকায় দোকানমালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে সমালোচনা আছে। পুলিশ কিছুটা বিলম্বে ঘটনাস্থলে গিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। ছোট্ট ঘটনাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল।