ভবনের বসবাস সনদ
নিয়ম আছে, মানে না কেউ
ভবন তৈরির পর রাজউকের কাছ থেকে বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক। ৫৫ হাজারের মধ্যে নিয়েছে মাত্র ৩০০টি।
দুই বছর আগে বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জনের প্রাণহানির পরপরই ঢাকার বহুতল ভবনগুলোর অবস্থা পরিদর্শন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এতে প্রায় ৯৫ শতাংশ বহুতল ভবনে রাজউকের অনুমোদিত নকশার গরমিল এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থায় দুর্বলতা ধরা পড়ে। এসব ভবনের ব্যবহার বা বসবাস সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) ছিল না। কিন্তু ভবনগুলোর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভবনে বসবাস শুরু বা ব্যবহারের আগে রাজউকের কাছ থেকে বসবাস সনদ নিতে হবে। এ সনদ পেলেই কেবল ভবনের মালিক ভবনে উঠতে পারবেন বা ভাড়া দিতে পারবেন। নকশার সঙ্গে নির্মিত ভবনে ত্রুটিবিচ্যুতি পাওয়া গেলে বা অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকলে রাজউক সেই ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণাও করতে পারবে।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত রাজউকের আওতাধীন এলাকায় বসবাস সনদ নিয়েছে ৩০০টির মতো ভবন। প্রতিবছর সংস্থাটি গড়ে সাত হাজার নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমতি নেওয়ার পরের তিন বছর এই নকশার মেয়াদ থাকে। প্রতিবছর অনুমোদিত নকশার ৮০ শতাংশ ভবন নির্মিত হয়। সে হিসাবে গত ১৩ বছরে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় প্রায় ৫৫ হাজার ভবন তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ নির্মিত ভবনের মাত্র শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ বসবাস সনদ নিয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শনে যেসব ভবনে অনিয়ম পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলোকে সতর্ক করা হয়েছিল। ভবনগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখতে শিগগিরই রাজউকের একাধিক দল মাঠে নামবে। তিনি বলেন, কোনো ভবনের বসবাস সনদ না থাকলে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ না দিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বলা আছে। কিন্তু সেটি মানা হচ্ছে না। সংস্থাগুলোকে আবারও চিঠি দেওয়া হবে।
* বসবাস সনদ না নেওয়ায় নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। * রাজউকের পরিদর্শনে প্রায় ৯৫% বহুতল ভবনের নকশার সঙ্গে নির্মাণের গরমিল পাওয়া যায়।
নগর–পরিকল্পনাবিদ ও রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, বসবাস সনদ না নেওয়ায় নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো ভবনমালিক অনিয়ম করে নকশায় পরিবর্তন আনলেও তা ধরা পড়ছে না। ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ফলে নির্মিত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও তা চিহ্নিত হচ্ছে না।
একটি ভবনের ব্যবহার সনদ নিতে রাজউকের ফি ৫০০ টাকা। সনদ না নিলে রাজউক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে সংস্থাটির সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর–পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বসবাস বা ব্যবহার সনদ নেওয়া নিশ্চিত করতে পারলে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানো যেত। ভবনমালিকেরা এ সনদ নিতে আগ্রহী না। রাজউকও জননিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।
ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পর তা ব্যবহারের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। এরপর সনদ নবায়নও বাধ্যতামূলক।
রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটছে। দেখা যায়, আট তলার অনুমোদন নিয়ে ৯ বা ১০ তলা ভবন করা হচ্ছে। আবার প্রস্থ বাড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। নির্মাণ শেষে ব্যবহার সনদ না নেওয়া হলেও এসব ভবনমালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনার পর জানা যায়, ভবনটিতে নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল। ভবনটির ১৯ থেকে ২৩তম তলা অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল।
বসবাস সনদ নেওয়া নিশ্চিত করতে পারলে বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানো যেত। ভবনমালিকেরা এ সনদ নিতে আগ্রহী নন। রাজউকও জননিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।আদিল মুহাম্মদ খান, নগর–পরিকল্পনাবিদ
ভবন নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হয়েছে কি না এবং অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিকমতো আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে রাজউকের দল। রাজউকের আইন অনুযায়ী, একটি ভবন ১০ তলা বা এর বেশি উচ্চতার হলে সেটিকে বহুতল হিসেবে গণ্য করা হয়। রাজউক সূত্রে জানা যায়, বনানীর এফ আর টাওয়ারে দুর্ঘটনা পরিদর্শন করে ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন পাওয়া যায়। এর ৯৫ শতাংশ ভবনের ক্ষেত্রেই রাজউক অনুমোদিত নকশার গরমিল এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থায় দুর্বলতা পাওয়া যায়। এসব ভবনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নির্ধারণে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিলে সেটি নিয়ে রাজউকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় আলোচনা হয়।
রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১ শাখার পরিচালক মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শনে প্রায় সব বহুতল ভবনে অনুমোদিত নকশার কোনো না কোনো বিচ্যুতি পাওয়া যায়। রাজউকের পর্ষদ থেকে গঠিত কমিটিকে ভবনগুলোর বিষয়ে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ করতে বলা হয়। কমিটি এখনো তাদের সুপারিশ জমা দেয়নি।
অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত
ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ছয়তলার ওপর যেকোনো ভবনই বহুতল। বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটা অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা কেমন আছে, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না, কাছাকাছি পানির সংস্থান কোথায় আছে, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি না, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ৫৭৭টি প্রস্তাবিত ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নকশা অনুমোদনের প্রাথমিক অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়েছে।
নগরবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, বসবাস সনদের সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই আসল কাজ হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম বাড়াতে হবে। ভবন ব্যবহারের আগে বসবাস সনদ নিতে মালিকদের বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে মাঠপর্যায়ে তদারকি করাতে হবে।