বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর লেখায় নিজের জীবন ও বাংলা গানের পাশাপাশি উঠে এসেছে ইতিহাসের যাত্রাপথও। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ জীবনের গান-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করলেন অভিনেতা ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৯৮ পৃষ্ঠার জীবনের গান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হলো রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল বুক-এ।
ছয় দশক ধরে বাংলা গানে বিশেষ অবদান রাখছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। একুশে পদক ও পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ গুণীজনের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী ও বিশিষ্টজনেরা।
শিল্পী সৈয়দ হাদীর দীর্ঘ কর্মময় জীবনের বিভিন্ন না জানা টুকরো টুকরো গল্প বলতে একের পর এক মঞ্চে আসেন তাঁর সতীর্থরা। অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে লেখক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, জীবনের গানের পাশাপাশি সৈয়দ হাদী তাঁর বইয়ে বাংলা গানের জীবনও তুলে ধরেছেন, তাই বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়।
জীবনের গান বইটির মোড়ক উন্মোচন করতে মঞ্চে উপস্থিত হন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ আব্দুল হাদী, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, নায়ক আলমগীর এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
নায়ক আলমগীর বলেন, সৈয়দ হাদীর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সময় গানের সুর শুনে খেলা থেমে যেত। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা শেষে মঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাঁকে ডেকে নেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী। ‘তুমি আমার জীবনসাথি’ গান শুরুর আগে আলমগীর জানালেন, সৈয়দ হাদীর কাছে তিন মাস গান শিখেছিলেন তিনি।
ফাল্গুনের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আসলে হয়ে উঠেছিল শিল্পীদের মিলনমেলা। প্রবীণ শিল্পী খুরশীদ আলম মঞ্চে উঠেই আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘একজন সৈয়দ আব্দুল হাদী শিল্পী হয়েছেন বলেই আমরাও শিল্পী হয়েছি।’ এ সময় শিল্পীদের স্মৃতিচারণায় শুরু হয় পুরোনো দিনের গান রেকর্ডিংয়ের গল্প।
সৈয়দ হাদীর কণ্ঠস্বর আল্লাহ প্রদত্ত সুরেলা উল্লেখ করে সংগীত ব্যক্তিত্ব খুরশীদ আলম তাঁদের দীর্ঘদিন একসঙ্গে মাছ ধরার গল্প শোনালেন সবাইকে। ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম’ গানটির সুর দেওয়ার স্মৃতিচারণা করে গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলছিলেন, বইটি সৈয়দ আব্দুল হাদীর জন্য শেষ কিছু নয়। এখনো তাঁর অনেক কিছু দেওয়ার আছে। বাবার প্রসঙ্গ আসতেই সৈয়দ আব্দুল হাদী তাঁর বাবার জায়গায় আছেন বলে জানালেন শিল্পী সামিনা চৌধুরী। একজন ভালো শিল্পীর পাশাপাশি সৈয়দ আব্দুল হাদীর মতো ভালো মানুষ হওয়া অনেক বড় অর্জন—বলছিলেন শিল্পী আবিদা সুলতানা ও ফাতেমা তুজ জোহরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আরও স্মৃতিচারণা করেছেন শেখ সাদী খান, রফিকুল আলম, লিনু বিল্লাহ্ ও শুভ্র দেব। উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন কেরামত মাওলা, শিল্পী আঁখি আলমগীর।
আয়োজনের প্রথম বক্তা হিসেবে প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, ‘সৈয়দ আব্দুল হাদীর জীবনে অন্যতম অর্জন, তাঁর জীবনে কোনো শত্রু নেই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ে যে শিল্পীদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, তার মধ্যে সৈয়দ আব্দুল হাদী অন্যতম। সংগীতই তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয়। আর সে কথা স্পষ্ট হয় এ আত্মজীবনীতে।’
অনুষ্ঠানের সবশেষ বক্তা হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত হন সৈয়দ আব্দুল হাদী। এ প্রজন্মের তরুণ শিল্পী মুহিন, সাব্বির, কিশোর, কুনাল, দিঠিসহ সব শিল্পীকে নিয়ে তিনি গাইলেন ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি’ গানটি। এর আগে সবার অনুরোধে ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দূরদেশ চলচ্চিত্রের ‘যেও না সাথি, চলেছ একেলা কোথায়’ গানের সুর তুলতেই একাত্ম হয়ে সুর মেলালেন উপস্থিত শিল্পীসহ সবাই।
জীবনের গান বই নিয়ে বলতে বলতে প্রবীণ এই গুণী শিল্পী যেন কষ্টের স্বরেই বললেন, ‘পথে এখন আর আমার চেয়ে প্রবীণ কাউকে সহসা পাই না।’ জানালেন, ‘সাধারণ মানুষের জীবনী লেখার একটি কারণ থাকতে পারে; প্রতিটি মানুষের অবয়ব এক হলেও প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র। আমি সারা জীবন আনন্দের সন্ধান করেছি, তবে ব্যক্তিভেদে আনন্দের সংজ্ঞা ভিন্ন। সারা জীবন নিজের সন্ধান করেছি আর তার সন্ধানই পাওয়া যাবে এ বইটিতে।’