দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নেই
মশা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এত দিন ধারণা করা হতো, শহরে এডিস ইজিপটাই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। অতিসম্প্রতি জানা গেছে, এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই মশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ধ্বংসে দেশে কেন্দ্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্মসূচি নেই।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, গোদ, জাপানিজ এনকেফালাইটিসসহ আরও অনেক রোগের বাহক মশা। দেশে প্রতিবছর এসব রোগে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়।
মশার প্রজননস্থল, ধরন, প্রজাতি, সংখ্যা, কোন ধরনের কীটনাশকে মশা মারা যায়, কোন ধরনের রোগের জীবাণু বহন করে, তা নিয়ে গবেষণা করেন কীটতত্ত্ববিদেরা। কিন্তু দেশে কীটতত্ত্ববিদের সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও (আইইডিসিআর) একই অবস্থা। স্থানীয় পর্যায়ে মাত্র ২৩-২৪ জেলায় কীটতত্ত্ববিদ আছেন। তবে তাঁদের বড় অংশ টেকনিশিয়ান থেকে পদোন্নতি পেয়ে কীটতত্ত্ববিদ হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অনেকটাই ভাটা পড়েছে। অভিযোগ আছে, কীটতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে কাজ পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একসময় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কর্মসূচি ছিল। এই কর্মসূচিতে ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশা নিধনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে যাওয়ায় অনেক দেশে এই কর্মসূচি সংকুচিত করা হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মশা বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, সারা বছর সব প্রজাতির মশা নিধনে কাজ করে যেতে হবে।’
এ বছরের জুলাই থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক আকারে দেখা দেওয়ার পর মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। তবে এই আলোচনা মূলত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কর্মসূচিকেন্দ্রিক। ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার পর এখন বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু বা এডিস মশার সমস্যা শুধু ঢাকা শহরের নয়, সারা দেশের।
>৬৪ জেলায় ডেঙ্গু শনাক্তের পর বলা হচ্ছে, এডিস মশার সমস্যা শুধু ঢাকা শহরের নয়, সারা দেশের।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, গোদ, জাপানিজ এনকেফালাইটিসসহ আরও অনেক রোগের বাহক মশা।
দেশে প্রতিবছর এসব রোগে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এবার সারা দেশে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী। একাধিক গ্রামেও রোগী পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ১৯৭টি মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে আইইডিসিআর। এগুলোর মধ্যে ১০১টি ঘটনা পর্যালোচনা করে ৬০টি মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর বেসরকারি হিসাবে এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছে ২১৫ জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও মশা বিশেষজ্ঞ কবিরুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২২টি জেলায় জরিপ করে এডিস ইজিপটাই শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সারা দেশের তথ্য আমাদের কাছে নেই। মশার জাতীয়ভিত্তিক জরিপ জরুরি হয়ে পড়েছে।’
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ১৯৩২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২২ প্রজাতির মশা নানা ধরনের রোগ ছড়ায়। কিন্তু এসব মশার চরিত্র–বৈশিষ্ট্য এক নয়। কোন ধরনের মশা কোথায় কী পরিমাণ আছে, তার তথ্যও কোথাও নেই।
২০০০ সালে ঢাকা শহরে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। ওই বছর এডিস মশাবাহিত এই রোগে মারা যায় ৯৩ জন। চিকুনগুনিয়াও এডিস মশাবাহিত রোগ। এই রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ২০১৭ সালে।
ম্যালেরিয়া ছড়ায় অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশার মাধ্যমে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলায় মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। এই শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ওই জেলাগুলোতে মশা মারার জন্য ঘরের মধ্যে কীটনাশক ছড়াই।’
রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব জেলায় নিয়মিত মশার জরিপ হয়। কোনো এলাকায় মশার উপস্থিতি বেশি হলে তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এলাকার মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী কীটনাশকযুক্ত মশারিও বিতরণ করা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের দু–একটি জেলায় গোদ রোগ ছড়াচ্ছে কিউলেক্স প্রজাতির মশা। আবার দেশের কোনো কোনো এলাকায় কালাজ্বর ছড়াচ্ছে বেলে মাছি।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মশা, মাছিসহ বেশ কিছু কীটপতঙ্গ নানা ধরনের বাহক হিসেবে কাজ করে। এসব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। আর রোগনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।’
এ ব্যাপারে জানতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা আইনে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে আছে। সম্প্রতি সারা দেশে যে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তার আওতায় ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশনগুলোকে মশকনিধনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে মশকনিবারণী দপ্তর নামে সরকারের একটি সংস্থা আছে। এই দপ্তরের এখন আর কোনো কাজ নেই বললেই চলে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব ও এই দপ্তরের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আ ম ম ফয়জুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দপ্তরটি ঢাকা শহরের মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে এর মাঠপর্যায়ের সব কর্মচারীকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সিটি করপোরেশনের হয়েই কাজ করেন।
বর্তমান আইইডিসিআর পাকিস্তান আমলে ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট ছিল। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ তথা মশক নিধন করা তাদের অন্যতম কাজ ছিল। অনেকে মনে করেন, মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশসহ বহু দেশে ম্যালেরিয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ম্যালেরিয়া কমে আসার কারণে মশা নিয়ন্ত্রণেও ভাটা পড়ে। পাশাপাশি পরিবেশবাদীরা মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে মশাসহ কীটপতঙ্গ বাড়ছে।
কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দরকার কেন্দ্রীয় মশকনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান। এর কাজ হবে মশা নিয়ে গবেষণা করা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা। পৃথিবীর একাধিক দেশে এমন প্রতিষ্ঠান আছে।’