তদন্তে পাওয়া তথ্য
তিতাসের গ্যাস থেকেই মগবাজারে বিস্ফোরণ
তদন্তে পৃথক পাঁচ সংস্থা। বিইআরসি বলছে, অভিযোগের ইঙ্গিত তিতাসের দিকে হওয়ায় তাদের কমিটিতে তিতাসের প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেট এলাকায় তিনতলা ভবনটিতে (বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত) গ্যাসের সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করেনি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। অবৈধ সেই সংযোগ থেকে গ্যাস ব্যবহার করা হতো ভবনে। তা ছাড়া সিটি করপোরেশনের পয়োনিষ্কাশন লাইনের কাজ করার সময় গ্যাসের সংযোগের পাইপলাইনের ছিদ্র (লিকেজ) থেকে গ্যাস বের হয়ে ভবনের নিচতলার শরমা হাউসের ভেতরে জমা হয়। সেখান থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে।
রাজধানীতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন ও ট্রান্সমিশন কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন বিস্ফোরণের পর উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ও তদন্ত কমিটিতে কাজ করা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাও বলেছেন, মগবাজারের ওই ভবনে গ্যাসের পাইপলাইন থাকার বিষয়টি তিতাসের তদন্তেও এসেছে। আর অবৈধ সংযোগ থেকে একটা সময় গ্যাস ব্যবহারের বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন ভবনের মালিকও।
তিতাসের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের সামনের রাস্তার পাশে তিতাস গ্যাসের একটি রাইজার (গ্যাস-সংযোগের পয়েন্ট) ছিল। ৭-৮ বছর আগে ওই ভবনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলেও ওই পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুসারে, এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার কথা।
জানা গেছে, বিচ্ছিন্ন সংযোগটি থেকে অবৈধ উপায়ে গ্যাস ব্যবহার করতে রাইজারটি সরিয়ে ভবনের সিঁড়ির পাশে নেওয়া হয়। দুর্ঘটনার পর সরেজমিনে সেখানে রাইজারের অবস্থান দেখা গেছে। ঘটনার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ভবনের মালিক মসিউর রহমানকে গ্যাসের সংযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তখন ভবনমালিক বলেছিলেন, কয়েক বছর আগে গ্যাসের লাইনটি তাঁরা ব্যবহার করতেন। পরে গ্যাস-সংযোগ তাঁরা বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি ভবনের সামনের রাস্তায় পয়োনিষ্কাশন লাইনের কাজ শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এতে খোঁড়াখুঁড়ির সময় তিতাসের পাইপলাইন ছিদ্র হয়। বিষয়টি তিতাসের নজরে না এনে পাইপলাইনের ওপর মাটি চাপা দিয়ে দেন কর্মরত শ্রমিকেরা। এরপর ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে পয়োনিষ্কাশন লাইনের ভেতর দিয়ে শরমা হাউসের নিচে পৌঁছায়। শরমা হাউসের রান্না করার স্থানেই পয়োনিষ্কাশন লাইনের ঢাকনা আছে। এটি দিয়ে ও রান্নায় ব্যবহৃত পানির লাইন দিয়ে গ্যাস শরমা হাউসের ভেতরে গিয়ে জমা হয়। আর আগুনের সংস্পর্শে এসে ঘটে বিস্ফোরণ।
* ৭-৮ বছর আগে ভবনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। * বিচ্ছিন্ন সংযোগটি থেকে গ্যাস ব্যবহার করতে রাইজারটি ভবনের সিঁড়ির পাশে নেওয়া হয়। * পয়োনিষ্কাশনের কাজের সময় পাইপলাইন ছিদ্র হয়, মেরামত না করে মাটি চাপা দেন শ্রমিকেরা।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টার মধ্যে একাধিকবার ফোন করা হয় তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহকে। তিনি ফোন ধরেননি। এরপর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে প্রশ্ন পাঠিয়ে উত্তর জানতে চাওয়া হয়। একই প্রশ্ন তিতাসের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মির্জা মাহবুব হোসেনকে পাঠানো হয়। কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ছয়টি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। দুর্ঘটনার দুই দিন পরই পেট্রোবাংলার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তিতাস। এতে ভবনে কোনো গ্যাস-সংযোগ না থাকায় দুর্ঘটনার সঙ্গে তিতাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করা হয়। পরিত্যক্ত রাইজারটির কথা উল্লেখ করা হলেও তার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। শরমা হাউসে থাকা এলপিজি সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে তারা।
তবে পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুজন কর্মকর্তা বলেন, এলপি গ্যাস তুলনামূলক ভারী হয়। এটি কোনোভাবে সিলিন্ডার থেকে বের হলেও তা ঘরের নিচের দিকে অবস্থান করে। বাতাসে জমে মগবাজারের মতো বিস্ফোরণের সুযোগ নেই। এ ছাড়া দুটি সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে, বিস্ফোরণের কোনো নমুনা নেই। তিতাসের প্রতিবেদনটি দায়সারা বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। এ ছাড়া ভবনে ব্যবহৃত এয়ার কন্ডিশনার বিস্ফোরণেরও কোনো নমুনা পায়নি কোনো তদন্ত কমিটি।
গত বুধবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে দাবি করে তারা। তবে গ্যাসের উৎস চিহ্নিত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। এর বাইরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে পেট্রোবাংলা, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলছেন, তিতাসের পাইপলাইন থেকে বের হওয়া গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া যাচ্ছে।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের কারণে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয়নি। আর পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির প্রধান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
এদিকে গত সোমবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সাত সদস্যের তদন্ত কমিটিতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। তবে তিতাসের কাউকে কমিটিতে রাখা হয়নি। এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের ইঙ্গিত তিতাসের দিকে হওয়ায় তাদের প্রতিনিধি রাখা হয়নি। খুব শিগগির তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে।
গত ২৭ জুন সন্ধ্যার পর মগবাজারের ওয়্যারলেস এলাকায় একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক। বিস্ফোরণের সময় বিকট শব্দে আশপাশের অন্তত সাতটি ভবনের কাচ উড়ে যায়। রাস্তায় থাকা তিনটি বাসের কাচ ভেঙে যায়।
বিস্ফোরণের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে গত ২৯ জুন রমনা থানার পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।