বিমানবন্দর থানার মামলা
ডাকাতির টাকায় বিপুল সম্পদ সেই এসআইয়ের
তদন্তে উঠে এসেছে, চাকরিচ্যুত এসআই আকসাদুদ ফ্ল্যাট, পোশাক কারখানা, গাড়ি ও একাধিক জমির মালিক।
ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপপরিদর্শক আকসাদুদ-জামান ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও পোশাক কারখানার মালিক। চলতেন দামি গাড়িতে। ঠাকুরগাঁও শহরে ও গ্রামে তাঁর কয়েক কোটি টাকার জমি রয়েছে।
ডাকাতির টাকা দিয়েই আকসাদুদ এসব সম্পদ করেছেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাজধানীর কাওলায় সৌদিপ্রবাসীর বিদেশি মুদ্রা ও মালামাল ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডিবির তদন্তে সম্প্রতি সিআইডির এসআই আকসাদুদের নাম আসে। ওই ঘটনায় ডিবি পুলিশের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ১৮ আগস্ট তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিআইডি। পরে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি।
৪ সেপ্টেম্বর মো. আকসাদুদ-জামানের স্ত্রীর সঙ্গে এক ব্যক্তির ১ কোটি ২৮ লাখ ও ১৪ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ওই দিন রাতে রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে আকসাদুদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
অডিওতে এক নারী বলছেন, ‘১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?’ অপর প্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠও টাকা কোনো এক স্যারকে দেওয়ার কথা বলছেন। পরে জানা যায়, নারী কণ্ঠটি এসআই আকসাদুদের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের। তাহমিনার দাবি, অপর প্রান্তের কণ্ঠটি ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশির। তাঁর স্বামীকে ডাকাতি মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে তিনি ওই টাকা ডিবি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছিলেন। অবশ্য কায়সার রিজভী কোরায়েশী ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, টাকা লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, আকসাদুদ ডাকাতির পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তিনি ২০১৩ সালে ডিএমপিতে কর্মরত থাকাকালে মতিঝিল অঞ্চলের একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারকে মাথায় অস্ত্র ঠেকান। এ ছাড়া কর্তব্যরত থাকাকালে আরেকবার শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তিনি। এর দায়ে দুবার বিভাগীয় শাস্তি ভোগ করেন আকসাদুদ।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আকসাদুদ সিপাহীবাগে পঞ্চমতলার যে ফ্ল্যাটে থাকেন, তা দুই বছর আগে ৮০ লাখ টাকায় কেনেন। ছয়-সাত বছর ধরে তিনি নিজের কেনা ব্যক্তিগত গাড়িতে চলতেন। ঢাকায় তাঁর তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আকসাদুদ ১৯৯৫ সালের ২৯ আগস্ট কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। ২০০২ সালে এএসআই হন তিনি। ২০১০ সালের ২৬ অক্টোবরে তিনি উপপরিদর্শক (এসআই) পদে পদোন্নতি পান। এরপর তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হতে থাকেন। আকসাদুদ ২০১৮ সালে সিআইডিতে বদলি হন।
প্রথম আলোর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি আকসাদুদের গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানান, আকসাদুদ এসআই হওয়ার পর বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশে দুই একর জমি কেনেন। দুই বছর আগে সেখানে আরও ১৬ বিঘা জমি কেনেন। এই জমির বাজারদর দুই কোটি টাকা। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঠাকুরগাঁও শহরের তাঁতীপাড়ায় আকসাদুদের পৌনে দুই কোটি টাকার জায়গা রয়েছে। সম্প্রতি বালিয়ায় তিনি আরও ৩৭ শতাংশ জমি কেনেন।
তদন্ত সূত্রমতে, আকসাদুদ বর্তমানে সব মিলে ৫০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিএমপির ডিবি সূত্র জানায়, সম্প্রতি আকসাদুদের একটি ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে সোর্স আমির তাঁকে ১২ লাখ টাকার ডাকাতি করার প্রস্তাব দেন। এ সময় আকসাদুদকে বলতে শোনা যায়, ২০ লাখের নিচে কোনো কাজ করবেন না। ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, বিমানবন্দর এলাকাকেন্দ্রিক সংঘটিত অধিকাংশ ডাকাতি আকসাদুদের নেতৃত্বে হয়েছে।
গত বছরের ১৯ অক্টোবর সকালে বিমানবন্দর সড়কের কাওলায় দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া ও তাঁর ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে ডিবি পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের মারধর করে সঙ্গে থাকা পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, দুই হাজার দিরহাম, মুঠোফোন, কাপড়ভর্তি লাগেজসহ মালামাল ডাকাতি করে তাঁদের পাশের জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। সৌদি আরবে রোমানের কাপড়ের ব্যবসা আছে। জমিজমা বিক্রি করে ওই টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তির সহায়তায় কয়েক মাস আগে ছয় ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে হাসান রাজার (চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য) আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আকসাদুদের নাম আসে। ডাকাতিতে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের চালক হারুন অর রশিদ ওরফে সজীব, অটোরিকশাচালক জোনাব আলী এবং কায়ছার মাহমুদ ওরফে জাকির হোসেন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রিমান্ডে আকসাদুদের ছয় সহযোগী জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে বলেন, তিন বছর আগে আকসাদুদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। তখন থেকে আকসাদুদের নেতৃত্ব তাঁরা ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। কয়েক মাস আগে আকসাদুদের ছয় সহযোগী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তাঁরা হলেন চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য হাসান রাজা, মোশাররফ হোসেন, সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন তালুকদার (পুলিশ সোর্স) ও রিজু মিয়া সিকদার। এঁদের মধ্যে হাসান রাজার বিরুদ্ধে তিনটি ডাকাতির মামলা, সেলিম মোল্লার বিরুদ্ধে চারটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক মাকসুদুল ইসলাম বলেন, আকসাদুদ সিআইডির গাড়ি ডাকাতিতে ব্যবহার করতেন। প্রবাসীর অর্থ ডাকাতির ঘটনায় আকসাদুদসহ এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রের আরেকজন পলাতক। মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। শিগগিরই এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।