রাজধানীর গণপরিবহন
অবৈধ, তবু স্বচ্ছন্দে চলে স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের বাস
ট্রাফিক পুলিশ দেখেও ‘দেখে না’। সাধারণ মালিকদের কাছ থেকে দিনে প্রতি বাসে ৯০০ টাকা আদায়।
রুট পারমিট ছাড়া নির্ধারিত রুটে বাস চালানো অবৈধ। তবে এই পারমিট না থাকা কোনো বাধা নয় ঢাকার সাইনবোর্ড-জিরানী বাজার রুটের (এ-৩১৩) স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের অধীনে চলা বাসের ক্ষেত্রে। ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়েই বাসগুলো অবৈধভাবে সড়কে নেমে যাত্রী পরিবহন করছে।
অবশ্য রুট পারমিট ছাড়া বাস চালানোর ক্ষেত্রে সাধারণ বাসমালিকদের ব্যয় অনেক বেশি। স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের অধীনে বাস চালাতে তাঁদের দৈনিক কোম্পানিকে গেট পাস বা জিপি বাবদ দিতে হয় ৯০০ টাকা। সব কটি বাস থেকে মাসে চাঁদা আদায় হয় প্রায় ১৯ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের অধীনে এখন ৭০টি বাস রয়েছে। এর অন্তত ৬০টির সংশ্লিষ্ট পথে চলাচল করার রুট পারমিট নেই। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি চালু হওয়ার সময় মাত্র ১০টি বাসের রুট পারমিট নিয়েছিল। করোনার আগে এটি বন্ধ হয়ে যায়। গত ৩০ অক্টোবর আবার কোম্পানিটি চালু করা হয়। ২০১৯ সালের পর রুট পারমিট অনুমোদনের জন্য কোনো সভা হয়নি।
স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কোম্পানির অধীনে চলা কিছু বাসের রুট পারমিট আছে। কিছু বাসের পারমিটের জন্য আবেদন করা আছে।
উল্লেখ্য, নাছির উদ্দিন ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আর বাস কোম্পানিটি নতুন করে চালুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন ঢাকা-১৮ আসনের সাংসদ হাবিব হাসান। এ বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও সাংসদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নেই।
ঢাকায় পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির একটি উদাহরণ এই স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকার অনেক বাসেরই রুট পারমিট থাকে না। বাস চলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে খোলা কোম্পানির অধীনে। সাধারণ মালিকদের কাছ থেকে আদায় করা চাঁদার ভাগ যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার কাছে।
সরেজমিন
সরেজমিনে গত বুধবার উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের ব্যানারযুক্ত বাসগুলোর শ্রমিকেরা আশুলিয়া, বাইপাইল ও নবীনগর গন্তব্যে যাত্রী তুলছেন। আবদুল্লাহপুরে এই কোম্পানির অধীনে চলা দুটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০৭২২ ও ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০৪৬৫ চালক ও চালকের সহকারী জানান, বাস দুটি আগে আশুলিয়া ক্ল্যাসিক নামের একটি কোম্পানির অধীনে চলত। আরেকটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-১১৪৫) চালক শহিদুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁদের বাসটি আগে সৌরভ পরিবহনের অধীনে চলত।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ তিনটি বাসের একটিরও এ-৩১৩ নম্বর রুটের পারমিট নেই। আশুলিয়া ক্ল্যাসিকের অধীনে চলা বাসের পারমিট ছিল ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে। আর সৌরভ পরিবহনের কোনো রুট পারমিট ছিল না। দুটি পরিবহন কোম্পানিই এখন বন্ধ। মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মালেক বিআরটিএকে গত ২ নভেম্বর চিঠি দিয়ে ২২টি বাসের রুট পারমিট বাতিল করতে বলেছিলেন। কারণ, বাসগুলো আন্তজেলা রুট পারমিট নিয়ে অবৈধভাবে ঢাকা শহরে চলছে। এই তালিকায় আশুলিয়া ক্ল্যাসিকের ব্যানারে চলা ওই দুটি বাসও ছিল।
যাচাইয়ে গড়িমসি পুলিশেরভ
স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনের অধীনে চলা বাসের রুট পারমিট আছে কি না, তা যাচাইয়ে গত বুধবার কামারপাড়া ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তবে তা পাওয়া যায়নি। ওই এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) তানভীর আহম্মেদ মুঠোফোনে বলেন, তিনি দুপুরের (বুধবার) পরে দায়িত্ব নেবেন।
ওই দিন দুপুরের পালায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট সোহেল রানা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মা-বাবাকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে গেছেন। পরে বেলা সাড়ে তিনটায় আবদুল্লাহপুরের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে গিয়ে বিষয়টি জানালে সেখানে থাকা পুলিশের পক্ষ থেকে রুট পারমিট যাচাইয়ে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী রুট পারমিটহীন বাস ট্রাফিক পুলিশ ডাম্পিংয়ে পাঠাতে পারে। তবে তা করতে খুব একটা দেখা যায় না। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তবে পুলিশ জরিমানা করতে পারে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকলে সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি আইন প্রয়োগ করা যায়।
আদালত অবশ্য ছেড়ে দিচ্ছেন
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি চলতি মাসে কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এতে সামান্য জরিমানা করে রুট পারমিটহীন বাস ছেড়ে দেওয়া হয়। কমিটির গত ২৮ নভেম্বরের সভায় জানানো হয়েছিল, রাজধানীতে রুট পারমিট ছাড়া বাস চলে ১ হাজার ৬৪৬টি।
ঢাকার শেওড়াপাড়া–মতিঝিল রুটের যাত্রী আবদুল্লাহ ফয়সাল নামের এক যাত্রী বলেন, মাস শেষে মাসোয়ারা না গেলে তাঁরা ঠিকই লক্কড়ঝক্কড় ও রুট পারমিটহীন বাসগুলো দেখতে পেতেন।