‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’দের নিয়ে বইটি আলো ফেলেছে অন্ধকার অধ্যায়ে
রাজধানীর ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডে একটি বাড়ির নাম ছিল ‘সাদা বাহার’। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন সেবার প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল এ বাড়িতে। সেবায় যুক্ত ছিলেন হালিদা হানুম আখতার। সেই নারীদের তিনি ‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করছেন।
হালিদা হানুম আখতার পেশায় চিকিৎসক। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর খ্যাতি আছে। ২৭ বছর বয়সে সাদা বাহারে কাজ করার সুযোগ আসে তাঁর। চার বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বইটি লিখেছেন। বইটির নাম দিয়েছেন—‘সম্ভ্রমযোদ্ধা: সেবাসদন ও একজন ডা. হালিদা’। আজ শনিবার বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
একাত্তরে নির্যাতনের শিকার নারীরা বীরাঙ্গনা নামেই স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই নারীদের জন্য নতুন শব্দ ‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’ কোনো বিতর্ক বা সংশয় সৃষ্টি করে কি না, তা নিয়ে অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তোলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীদের সমাজ একীভূত করে নেয়নি। আপদ মনে করেছে। নির্যাতিত নারী কেউ কেউ পাকিস্তানে চলে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধের গৌরব আমরা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এর মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারিনি।’
‘সম্ভ্রমযোদ্ধা’ শব্দটি টিকে থাকবে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। তাঁর মতে, সময়কে ধারণ করে ভাষা বা শব্দ। সম্ভ্রমযোদ্ধা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই আছে। তিনি বলেন, ‘হৃদয় থেকে বলা কথা আছে এই বইয়ে।’
অনুষ্ঠান শুরু ও শেষ হয়েছিল বইয়ের লেখক হালিদা হানুম আখতারের বক্তব্য দিয়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলা অনুষ্ঠান শেষের আগে তিনি বলেন, সাহস করে তিনি এই নতুন ধরনের কাজটি করেছেন। যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
হালিদা হানুম আখতার কৃতজ্ঞতা জানান শিরিন জাহাঙ্গীরের প্রতি। শিরিন জাহাঙ্গীর ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালক। আজকের অনুষ্ঠানে শিরিন জাহাঙ্গীর বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ পুনর্বাসন সেবা শুরুর দিকে অনেকে বেশ কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। লাখ লাখ অসহায় নারীর জন্য সারা দেশে ৩০টি পুনর্বাসন কেন্দ্র করা হয়েছিল। বোর্ডের পক্ষ থেকে এই নারীদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। এনজিওরা আসে আরও পরে।
শিরিন জাহাঙ্গীর জানান, মাদার তেরেসা একাধিকবার এ সেবাসদনে এসেছিলেন মা-বাবাদের ফেলে যাওয়া শিশুকে তাঁর আশ্রমে নেওয়ার জন্য।
হালিদা হানুম আখতার তাঁর লেখা ৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ওই সময় আরও বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল, সন্তান জন্মের পর ওই মেয়েদের অনেকেই ঘন ঘন আমাদের কাছে জানতে চাইত, তাদের বাড়ি থেকে কেউ খোঁজ নিয়েছিল কি না। বাবা, ভাই, মা—কেউ ফোন করেছিল কি না। এটা সত্যি যে যারা একবার তাদের রেখে গেছে, কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি।...মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ যখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, তখন নির্যাতিত এই নারীরা নীরবে কাঁদছে; কিছুদিন পর তাদের অনেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও ক্রমাগত নিজেদের লুকানোর পথ খুঁজছে।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আ হ ম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পরপর চট্টগ্রামে মা-বাবার ফেলে যাওয়া তিন-চারটি শিশুকে তিনি বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আরও অনেকেরই হয়তো আছে।
আন্তর্জাতিক এনজিও ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে বইটি কিনে পড়ার অনুরোধ জানান। চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জান্নাতুল বাকেয়া কেকা বলেন, বইটি আরও ১০-১৫ বছর আগে লেখা হলে আরও ভালো হতো।
একটি অসাধারণ কাজ করেছেন বলে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মনসুর মুসা। তিনি বলেন, বইটি লিখে অন্ধকারাচ্ছন্ন, তমসাচ্ছন্ন একটি অধ্যায়ের উন্মোচন করেছেন হালিদা হানুম আখতার।