কক্সবাজার শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। আজ রোববার সকাল ৯টা থেকেই ৭০ হাজার শরণার্থীর এই আশ্রয়শিবিরের ফুটবল খেলার মাঠে রোহিঙ্গারা জড়ো হচ্ছিলেন রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর পূর্তির ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের জন্য। বেলা ১১টার দিকে বিশাল মাঠটি ভরে যায় ২০-২৫ হাজার রোহিঙ্গার উপস্থিতিতে। তাঁদের ৮০ শতাংশ কিশোর-তরুণ।
বেলা সোয়া ১১টায় শুরু হয় সমাবেশ। সেখানে কয়েকজন বক্তার মুখে উঠে এল, রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। জান্তা সরকারের দমন–নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গারা এখন সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। বিদ্রোহীরা রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হত্যাও করছে তাঁদের। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নতুন সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা চান রোহিঙ্গারা।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ছাত্র-জনতার এই বিজয় রোহিঙ্গাদের জন্য বড় অনুপ্রেরণার বিষয়। রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছেন ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হলে দুনিয়ার কোনো শক্তি টিকে থাকতে পারে না। তেমনিভাবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামলে তাঁদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের দিন শেষ হবে বলে মনে করেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর গড়ে তোলা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা পিস ফর হিউম্যান রাইটসের কয়েকজন নেতা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কামনা করে রোহিঙ্গা নেতা ছৈয়দ উল্লাহ সমাবেশে বলেন, এ দেশে কোন সরকার এল বা কোন সরকার গেল, তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাথাব্যথা নেই। তবে রোহিঙ্গারা চান দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকুক। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বেগ পেতে হবে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর এখন দ্বিতীয় গণহত্যা চলছে দাবি করে রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন বলেন, ‘মংডুতে প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ বর্বর নিযাতন চালানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পরিচয় মুছে দিতে চায় তারা। অথচ মিয়ানমারের অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় আছে। এ ক্ষেত্রে জান্তা আর আরাকান আর্মির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী-জনতা এক হলে অধিকার ফিরে পেতে এক বছরও লাগবে না।’
১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা এ দেশের অতিথি। তবে দিন অনেক গড়িয়েছে, আর নয়। আমাদের এখনই জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া উচিত। ঐক্যবদ্ধ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে। মিয়ানমারে না গিয়ে অন্য দেশে গেলে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব থাকবে না।’
সমাবেশে পাঁচ দফা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের সহিংসতা ও হামলা বন্ধ, আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সুযোগ তৈরি, জান্তা ও আরাকান আর্মিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা। দুপুর ১২টার দিকে সমাবেশ শেষ হয়। এ সময় বাংলাদেশে বন্যা আক্রান্ত ১০ লাখ মানুষের জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন রোহিঙ্গা নেতারা।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।