সাত দিন ধরে বন্ধ নৌযান চলাচল, সেন্ট মার্টিনে খাদ্যসংকট

মিয়ানমার থেকে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে পড়ে আছে ট্রলার। গতকাল বিকালেছবি- প্রথম আলো

সাত দিন ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানের চলাচল বন্ধ রয়েছে। নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ বদরমোকাম এলাকার বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে বাংলাদেশি নৌযান লক্ষ্য করে দফায় দফায় গুলি ছোড়া হচ্ছে। গুলিতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এই কারণে এই পথে বন্ধ হয়ে গেছে নৌযান চলাচল। এতে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের ১০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। দ্বীপে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট।

নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় সাত দিন ধরে দ্বীপের মানুষ জরুরি প্রয়োজনে টেকনাফ যেতে পারছেন না। টেকনাফ থেকেও সেন্ট মার্টিনে পাঠানো যাচ্ছে না চাল, ডাল, ডিম, মুরগি, ভোজ্যতেল, জ্বালানি, শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। ফলে দ্বীপে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশি নৌযান লক্ষ্য করে দফায় দফায় গুলি ছোড়ার ঘটনায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠাচ্ছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রোগীবাহী একটি স্পিডবোট লক্ষ্য করে মিয়ানমার থেকে ১০-১২টি গুলি ছোড়া হয়। কয়েকটি গুলি স্পিডবোটে লাগলেও অল্পের জন্য যাত্রীরা প্রাণে রক্ষা পান।

এর আগে ৮ জুন দুপুরে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনগামী পণ্যবাহী একটি ট্রলারে ৩০-৪০টি গুলিবর্ষণ করে মিয়ানমার সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাতে কেউ হতাহত না হলেও ট্রলারটির বিভিন্ন স্থানে সাতটি গুলি লাগে।

ট্রলারের মালিক ও সেন্ট মার্টিন সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকাটি একসময় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি বিজিপির কয়েকটি সীমান্তচৌকি দখলে নেয় দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। ৫ জুন সেন্ট মার্টিন থেকে নির্বাচনী সরঞ্জামসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি ট্রলার টেকনাফ ফিরছিল। সন্ধ্যায় ট্রলারটি নাফ নদীর বদরমোকাম এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিকের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে ট্রলার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। ট্রলারে ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফকাত আলীসহ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা। ট্রলারের গায়ে বেশ কয়েকটি গুলি লাগলেও যাত্রীরা ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান বলেন, রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় গত সাত দিন ধরে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযানের চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীসহ হতদরিদ্রদের ভিজিডি ও ভিজিএফ চালও সেন্ট মার্টিনে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ওপারের গুলিবর্ষণ বন্ধ না হলে দ্বীপের ১০ হাজার মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। নৌ চলাচল স্বাভাবিক করতে নাফ নদীর বদরমোকাম এলাকায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও বিজিবির টহল জোরদার করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশি নৌযান লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবির কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়। কিন্তু গোলাগুলি বন্ধ হচ্ছে না।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের দিক থেকে কারা গুলি ছুড়ছে, আরাকান আর্মি নাকি বিজিপি, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সংকটের অবসান না হওয়া পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে নৌ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় টেকনাফ থেকে আসছে না কোনো পণ্যবাহী ট্রলার। এতে দেখা দিয়েছে নিত্যপণ্যের সংকট। সেন্ট মার্টিনের দোকানগুলোতে মিলছে না নিত্যপণ্য। গতকাল বিকেলে
প্রথম আলো

খাদ্যসংকট, দুর্ভোগ

দ্বীপের পূর্ব দিকে জেটিঘাটে কয়েক শ দোকান-হোটেল রেস্তোরাঁ নিয়ে সেন্ট মার্টিনের প্রধান বাজার। গতকাল মঙ্গলবার খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অধিকাংশ দোকানপাটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী মজুত নেই। কয়েকটি দোকানে কিছু তরকারি, চাল-আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, জ্বালানি থাকলেও তা বেচাবিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। বাজারের উত্তর পাশে একটি দোকানে গতকাল একটি ডিম বিক্রি হয়েছে ২০ টাকায়। ১ কেজি আলু ৯০ টাকায়।

দোকানের মালিক মো. হোসেন বলেন, ছয়-সাত দিন ধরে নৌযান চলাচল বন্ধ, টেকনাফ থেকে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনা যাচ্ছে না। আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে তিনি ১০ দিন আগে ৩ লাখ টাকার সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডিম ও চাল নিয়ে এসে গুদামে মজুত করেছিলেন। মানুষের কষ্ট হচ্ছে দেখে মজুত মালামাল বিক্রি করছেন। কিন্তু গুলিবর্ষণ বন্ধ না হলে দ্বীপের মানুষ না খেয়ে মরবেন।

সেন্ট মার্টিন বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য হাবিবুল্লাহ খান বলেন, টেকনাফের সঙ্গে নৌযোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে দ্বীপে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে ৯৬টি দোকান, ১০টি সবজি ও ১০টি চাল বিক্রির দোকান খালি হয়ে পড়েছে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, খাদ্যসংকট নিরসনে নাফ নদীর পরিবর্তে বঙ্গোপসাগরের টেকনাফ উপকূল দিয়ে সেন্ট মার্টিনে খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাঠানো যায় কি না, তার চেষ্টা চলছে।