চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের চেইনম্যান (শিকলবাহক) নজরুল ইসলাম ঘুষের লাখ লাখ টাকা অগ্রিম নিতেন, তা–ও চেকের মাধ্যমে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা অনেকটা তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে আসা লোকজনকে ঘিরে চলত তাঁর এই ঘুষ–বাণিজ্য।
এসব ঘুষের টাকায় ১টি গাড়ি, ১টি বাড়ি, ২টি ফ্ল্যাট, ৩টি দোকানসহ ১১ কোটি ২১ লাখ ৬৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন নজরুল ও তাঁর গৃহিণী স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগপত্রে এই চিত্র উঠে আসে।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর নজরুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী তছলিম উদ্দিন নগরের চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে তাঁর (নজরুল) স্ত্রীর মালিকানাধীন দোকানে ধরা পড়েন দুদকের হাতে। ওই সময় নজরুলের কাছে পাওয়া যায় ঘুষের নগদ ৮ লাখ ৭ হাজার টাকা ও ৯১ লাখ ৮৩ হাজার টাকার চেক। এ ঘটনায় দুদক মামলা করে। ধরা পরার পর নজরুল ও তছলিমকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সাড়ে চার বছর তদন্ত শেষে দুদক গত ২৫ সেপ্টেম্বর এই মামলার অভিযোগপত্র দেয়।
অভিযোগপত্রে নজরুল ও তছলিম ছাড়াও এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার মো. সেলিম, দালাল নাসির আহমেদ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল) নগরের মুরাদপুর শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইব্রাহিম মিয়াকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে নজরুল ও তছলিম জামিনে, বাকিরা এখনো পলাতক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. আতিকুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম এলএ শাখার নিয়ন্ত্রণ ছিল শিকলবাহক নজরুল ইসলামের হাতের মুঠোয়। সিন্ডিকেট করে জমির মালিকদের হয়রানি করে চেকের মাধ্যমে অগ্রিম ঘুষ নিতেন নজরুল। এ জন্য নতুন করে ব্যাংক হিসাব খোলাতেন। ক্ষতিপূরণের টাকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি ঘুষ নেওয়া হতো।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, নজরুল এখন এলএ শাখায় নেই। এখন ঘুষ লেনদেন হয় না। আগে কী হতো, তা জানেন না।
যেভাবে অগ্রিম ঘুষ নিতেন
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, নজরুল ইসলাম একসময় চট্টগ্রাম জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের চেইনম্যান ছিলেন। নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায় চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের তিনটি দোকান ছিল তাঁর ঘুষ লেনদেনের কার্যালয়।
ঘুষ দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা নেওয়া নোয়াখালী সেনবাগের সৌদিপ্রবাসীর স্ত্রী নাছিমা বেগম দুদকে দেওয়া সাক্ষ্যে তাঁর হয়রানির কথা বলেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুই শতক জমি কিনে সেখানে একতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর জায়গাটি ২০১৯ সালে সরকারি একটি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য চট্টগ্রাম এলএ শাখায় যান। একপর্যায়ে এলএ শাখার সার্ভেয়ার মো. সেলিম নাছিমাকে চেইনম্যান নজরুলের মুঠোফোন নম্বর দেন। এরপর চেকের মাধ্যমে ঘুষের ৬ লাখ দিয়ে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর ক্ষতিপূরণের টাকা ৪০ লাখ ২৬ হাজার টাকা পান। নাছিমার মতো ভুক্তভোগী অন্তত ১৭ জনের কাছ থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নজরুল অগ্রিম চেকের মাধ্যমে ঘুষ নিয়েছেন বলে দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার সাবেক চেইনম্যান নজরুল ইসলামের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় তাঁর মালিকানাধীন নগরের ২ নম্বর গেট এলাকার দোকানে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ঘুষের টাকায় কোটিপতি
দুদক সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে ১ হাজার ৮০০ টাকা বেতনে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢোকেন নজরুল। দুদকের হাতে ধরা পড়ার
আগে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বেতন-ভাতা পান ২৯ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৬ টাকা। দুই ছেলের পড়াশোনা, সাংসারিক খরচসহ অর্ধেক বাদ দিয়ে তাঁর কাছে থাকার কথা ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৪৩৩ টাকা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, চেইনম্যান নজরুলের একার পক্ষে এত বড় দুর্নীতি করা সম্ভব নয়, তাঁর ঊধ্বতন কর্মকর্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।