বাংলাদেশ ও আশপাশে বাড়ছে ভূমিকম্প, শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ বলে মনে করেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা।

ভূমিকম্পপ্রতীকী ছবি

স্ত্রী-সন্তান শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় বাড়িতে একাই ছিলেন পঞ্চগড় শহরের মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা আশিক রায়হান। তিনি রাত জেগে স্মার্টফোনে ফেসবুক দেখছিলেন। তাঁর একটা অভ্যাস, বসে থাকলে পা ঝাঁকান। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ অনুভব করেন বিছানাটা কাঁপছে।

আশিক রায়হান বলছিলেন, ‘প্রথমে ভেবেছি পা নাড়ানোর কারণে হয়তো ঝাঁকুনি খাচ্ছে। পরে পা ঝাঁকানো বন্ধ করার পরও দেখি বিছানা কাঁপছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বের হই আর মাকে ডাকতে শুরু করি। পরে আমার ডাকাডাকিতে মা–সহ পরিবারের সবার ঘুম ভাঙে, তারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।’ 

উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহরের অনেকেই বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ভূমিকম্পের এ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

 আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র সূত্র বলছে, দিবাগত রাত ৩টা ৬ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল নেপালের কোদারি এলাকা। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। এটি মাঝারি মাপের ভূমিকম্প।

এর আগে বুধবার মধ্যরাতে সিলেটে এবং মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূকম্পন অনুভূত হয়। 

প্রথমে ভেবেছি পা নাড়ানোর কারণে হয়তো ঝাঁকুনি খাচ্ছে। পরে পা ঝাঁকানো বন্ধ করার পরও দেখি বিছানা কাঁপছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বের হই আর মাকে ডাকতে শুরু করি। পরে আমার ডাকাডাকিতে মা–সহ পরিবারের সবার ঘুম ভাঙে, তারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে
আশিক রায়হান

বুধবারের (২৬ ফেব্রুয়ারি) ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩। 

আর মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। 

এভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরেও ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এভাবে ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ বলে মনে করছেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা। ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পরম্পরা বিশ্লেষণ এবং দিন দিন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই এমনটা মনে করছেন তাঁরা।

ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেড়ে গেলেও তাকে মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাব আছে বলেই তাঁরা মনে করেন। এখনো ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ভূমিকম্প-পরবর্তী সম্ভাব্য উদ্ধার প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর জন্য নাগরিক শিক্ষা ও মহড়া—উভয়েরই অভাব আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এভাবে বাংলাদেশের আশপাশে ও দেশের ভেতরেও ছোট বা মাঝারি আকারের ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ভূমিকম্প বাড়ছে আশপাশে

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগের প্লেটগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। এগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তরঙ্গ শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর সেখানে পৌঁছানোর পর শক্তি অটুট থাকলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই ভূমিকম্প। 

এই প্লেটের নানা ভূগর্ভস্থ চ্যুতি আছে। সেগুলোই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। 

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তর–পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের এলাকাগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। দেখা যাচ্ছে, এসব স্থানে ভূমিকম্প বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪১। গত বছর তা বেড়ে হয় ৫৪।

ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলছিলেন, ‘আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিট বেড়েছে। আগে ছিল চারটি। ২০০৭ সাল থেকে ১৩টির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হয়। তবে শুধু প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এখন পর্যবেক্ষণ বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যা বাড়ছে তা নয়। আসলে বাংলাদেশ ও কাছাকাছি এলাকায় ভূমিকম্প বাড়ছে। বৈশ্বিক তথ্যও সে বিষয়টি সমর্থন করে।’

কেন বাড়ছে ভূমিকম্প আর বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তের ভারত ও মিয়ানমারে ভূমিকম্পপ্রবণ। কিন্তু এখন এর প্রবণতা বৃদ্ধি কেন?

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ

ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার কারণ বোঝাতে একখণ্ড কাঠের টুকরার উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলছিলেন, কাঠের টুকরার দুই পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, তবে এর ভেতরে একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। একসময় উভয়মুখী চাপে কাঠটি চিড়ে যেতে পারে। একসময় টুকরাটা ভেতরে তৈরি হওয়া শক্তির চাপে ফেটে যাবে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের চিড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে। 

ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের মাত্রাগত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত দুই ধরনের ভূমিকম্পের কথা বলছেন তাঁরা। একধরনের ভূমিকম্প হলো রিখটার স্কেলে ৮ বা এর চেয়ে বেশি। আরেক ধরনের হলো ৭ বা এর চেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার মধ্যে সাধারণত ৮ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর ফিরে আসে। আর ৭ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে।

বাংলাদেশ বা এই ভূখণ্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী এমনটি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার।

১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। 

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী, বুয়েট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার একটি সময় হয়ে গেছে।

আমাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ইউনিট বেড়েছে। আগে ছিল চারটি। ২০০৭ সাল থেকে ১৩টির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ হয়। তবে শুধু প্রাযুক্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এখন পর্যবেক্ষণ বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যা বাড়ছে তা নয়। আসলে বাংলাদেশ ও কাছাকাছি এলাকায় ভূমিকম্প বাড়ছে। বৈশ্বিক তথ্যও সে বিষয়টি সমর্থন করে।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর

ঢাকা আছে বিপদে, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি  

গত বছর হওয়া ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। 

ভূমিকম্প মোকাবিলায় ২০২৪-২৫ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ১১টি ভূমিকম্পপ্রবণ শহর নির্ণয় এবং কনটিনজেনসি পরিকল্পনা হয় বলে জানান দুর্যোগবিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জরুরি সাড়া দান পদ্ধতিও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়াও থমকে গেছে। 

দেশের ভূমিকম্প প্রস্তুতি অনেকটাই ক্ষতি-পরবর্তী তৎপরতাকেন্দ্রিক বলে মনে করেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ভবন রাতারাতি ভেঙে ফেলা কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নয়। সেটা মাথায় রেখে শিক্ষাদান এবং সচেতনতা বাড়ানো দরকার। মানসিক মনোবল বৃদ্ধিতে মহড়া বাড়ানো যেতে পারে। সেগুলো দেখা যায় না।