‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ ঢাকা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নের গল্প
বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে যাত্রা হলো শুরু
৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে মেসি কি বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দিতে পারবে আর্জেন্টিনাকে? নাকি কিলিয়ান এমবাপ্পের হাত ধরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তুলবে ফ্রান্স? রাস্তাঘাটে, অফিসে বা ক্যাম্পাসে আড্ডায় কান পাতলেই শোনা গিয়েছিল এই আলাপ। এক মাস ধরে কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ছোঁয়ায় মেতে ছিল বাংলাদেশও। প্রিয় দলের পতাকা হাতে আর জার্সি গায়ে উৎসবে শামিল হয়েছিল কোটি মানুষ।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত, অর্থাৎ ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ডিসেম্বর। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ছিল মাতামাতি। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় ঢাকায় বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে উন্মাদনা ছিল একটু বেশিই। কিন্তু ওই দিন রাজধানীর পুরানা পল্টনে অবস্থিত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চিত্র ছিল ভিন্ন। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বলতে গেলে ছিল না তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা।
ভেন্যুতে কান পাততেই শোনা গেল একজনের চিৎকার: রাজাকে আটকে দে।
পাশ থেকে আরেকজনের প্রত্যুত্তর: আগে তোমার মন্ত্রী বাঁচাও। মন্ত্রীকে সৈন্য দিয়ে মেরে ফেলব এখন।
হুংকার দিয়ে উঠল পেছনে দাঁড়ানো লম্বা গড়নের একজন: ঘোড়া দিয়ে আক্রমণ করে সব সৈন্য মেরে ফেলব!
একটু দূরেই চলছিল দুই বন্ধুর আলাপচারিতা।
‘হাতি বাঁচাতে না পারলে তুমি রাজ্যছাড়া হবে।’
‘আমি নৌকা আর সৈন্য দিয়ে খেলা চালিয়ে যাব।’
না, ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। কোনো রাজ্য দখলের জন্য কেউ যুদ্ধে নামেনি। সারা বিশ্ব যখন ফুটবল নিয়ে ‘মাঠের যুদ্ধ’-এ লিপ্ত, তখন দাবার বোর্ডে ৩২টি ঘুঁটি নিয়ে ‘মগজের যুদ্ধ’-এ মেতে ছিল ঢাকা বিভাগের খুদে দাবাড়ুরা। এটা ছিল নিজের মেধা দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার যুদ্ধ। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর আয়োজিত ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ঢাকা বিভাগের খুদে দাবাড়ুরা। ‘হয়ে ওঠো আগামীর গ্র্যান্ডমাস্টার’ স্লোগানে দুই দিনব্যাপী প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রথম ও দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছে যথাক্রমে ডিপিএস এসটিএস স্কুল ও সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া সাকলাইন মোস্তফা সাজিদসহ দলটির অন্য সদস্যরা হলো অষ্টম শ্রেণির মেহরাব হক খান, নবম শ্রেণিপড়ুয়া মো. রাকিবুল ইসলাম ও প্রীতম সরকার। এই দলের অন্যতম সদস্য রায়ান রশীদ মুগ্ধ। প্রথম শ্রেণিপড়ুয়া মুগ্ধের দাবা খেলা নিয়ে মুগ্ধতা ইতিমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের মধ্যে বয়সভিত্তিক দাবা খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মুগ্ধ। তার রয়েছে ফিদে রেটিং। মুগ্ধর মেধার রশ্মি পেরিয়ে গেছে দেশের সীমানাও। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় জুনিয়র দাবা প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্বের ৫০ জন খুদে দাবাড়ুর মধ্যে চতুর্থ হয়ে বিশ্বদরবারে লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরেছে মুগ্ধ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মুগ্ধ পেয়েছে ওয়ার্ল্ড রেটিং, যা বিশ্ব রেকর্ড। মুগ্ধর ভাই মাসুদুর রশীদ জানায়, ‘মুগ্ধ যখন হাঁটতে শিখছে, তখন থেকেই তার দাবা খেলা শুরু। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার লক্ষ্যে সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রায়ান রশীদ মুগ্ধ ।’
চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য সাকলাইন মোস্তফা সাজিদ নিজ স্কুলের সেরা দাবাড়ু। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পেছনে সাজিদের উদ্দেশ্য একটাই—দেশের সব শিক্ষার্থীর মধ্যে সেরা হওয়া। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা সাজিদের ভাই জুলকার নাঈম বলেন, ‘আমাদের পরিবারের বাবা-মা-বোন সবাই মিলে দাবা খেলি। সেটা দেখেই ওর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এখন পরিবারের সবার মধ্যে সাজিদই ভালো দাবা খেলে। ইতিমধ্যে সে অর্জন করেছে “ক্যান্ডিডেট মাস্টার” খেতাব। কোনো দাবাড়ুর রেটিং ২,২০০ পয়েন্টের বেশি হলে তাকে এই খেতাব দেওয়া হয়।’
ভবিষ্যতে সাজিদ হতে চায় ‘ফিদে মাস্টার’। আর গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে বিশ্ব দাবায় দেশ ও নিজের নাম উজ্জ্বল করতে চায় সে। এ লক্ষ্যেই ইতিমধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আজারবাইজানে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করেছে সাজিদ।
১৭ ডিসেম্বর সকাল থেকেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে মেধাভিত্তিক এই লড়াইয়ে অংশ নিতে খুদে দাবাড়ুরা এসেছিল মা-বাবা, বন্ধু অথবা স্কুলশিক্ষকদের সঙ্গে। দাবা খেলতে স্কুলশিক্ষক মায়ের হাত ধরে এসেছিল নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মো. রাকিবুল ইসলাম। খেলা শুরুর আগেই সে বলেছিল, ‘আমি দাবা খেলে ভাইয়াকে সব সময় হারিয়ে দিই। বাবাও মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে হেরে যায়। এখন আমি এ প্রতিযোগিতায় সেরা হতে চাই।’ দিন শেষে তার কথা বাস্তবায়িত হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাকিবের স্কুল।
মেহরাব হক খানের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। ছেলের সাফল্যে আনন্দিত মেহরাবের বাবা জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই সব ধরনের খেলা ভালো খেলত মেহরাব। তবে ঢাকায় আসার পর মাঠের অভাবে তেমনভাবে খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই দাবা খেলার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তার। এখন মেহরাবের অবসর সময়ের বেশির ভাগই কাটে দাবার সঙ্গে। দাবার প্রতি আগ্রহ থেকেই এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছে সে। আমরাও তার এ অর্জনে খুব খুশি।’
বন্ধুর সঙ্গে খেলার কৌশল নিয়ে আলোচনা করছিল চ্যাম্পিয়ন দলের প্রীতম সরকার। সে বলে, ‘দাবা বুদ্ধি খাটিয়ে খেলতে হয়। কৌশলে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে হয়। সেই কৌশলই শেয়ার করে নিচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে। সারা দেশের মধ্যে সেরা হওয়ার জন্য প্রস্তুতিতে কোনো ছাড় দিতে চাই না।’
ঢাকা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দলের সব দাবাড়ুর স্বপ্ন ও লক্ষ্য এখন একটাই—দেশসেরা হওয়া এবং তারপর বিশ্বসেরা হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা।
উল্লেখ্য, বিভাগীয় পর্যায় থেকে নির্বাচিত ১৬টি স্কুল–দাবা দল আজ থেকে রাজধানীর রাজারবাগস্থ বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে অংশ নিচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায়।