নিজের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে দেশের যুবদের বড় একটি অংশের মধ্যে দ্বিধা, অস্বস্তি বা সংকোচ কাজ করে। তাঁদের অনেকে কোনো না কোনো সময় নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে হেনস্তা বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন যুবরা।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ’-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। শনিবার সকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে যুব সম্মেলনে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ তাঁদের মতামত প্রকাশে দ্বিধা, অস্বস্তি, সংকোচের কথা বলেছেন। অন্যদিকে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁরা অতীতে হেনস্তা, হয়রানির শিকার হয়েছেন।
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যুবদের মতামত তুলে ধরতে গত সেপ্টেম্বর ও চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অনলাইনে এই জরিপ করেছে। এতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দেশের ৫ হাজার ৭৫ যুব অংশগ্রহণ করেন। জরিপে তাঁদের কাছে ভোট ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নীতি যুক্ততা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিনিধিত্ব-সম্পর্কিত বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। যুব জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
সম্মেলনে ‘দেশ হোক তেমন যুবরা চায় যেমন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যে সারা দেশের কয়েক শ তরুণ অংশ নেন। এই সম্মেলনে যুব জরিপের ফলাফল প্রকাশের পাশাপাশি যুবসমাজ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত কি না, এ নিয়ে সংসদীয় বিতর্ক ছিল। এ ছাড়া যুবসমাজের চাহিদা ও প্রত্যাশা এবং যুবসমাজ কেন মূলধারার রাজনীতি করতে উৎসাহী নয়—এ নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতা ও বিশিষ্টজনেরা আলোচনা করেন।
সম্মেলনে যুব বেকারদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু, যুব বেকার ভাতা প্রদান, সম্পত্তিতে ভাই-বোনের সম-অধিকার নিশ্চিত করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিলসহ ১৪টি দাবির বিষয়ে উপস্থিত যুবদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইনে ভোট নেওয়া হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিল করার দাবির বিষয়টি।
এ প্রসঙ্গে সম্মেলনে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যুবরা দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন। এর অপব্যবহার নিয়েও আশঙ্কার কথা বলেছেন তাঁরা। যুবদের দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কার কথা নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় নিতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কাজ করছে বাংলাদেশ। এসব লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা থেকে মুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, শোভন কাজ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। ২০১৬ সালের জুন থেকে কাজ করা এই প্ল্যাটফর্মের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তোলা।
জরিপে আরও যা উঠে এল
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের কাছে উন্নয়ন বা রাজনীতিবিষয়ক খবরের তথ্যের প্রধান উৎস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে মনে করেন ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য বাধার মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। এই মত দিয়েছেন ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ যুব মনে করেন, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সুযোগ পেলে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যুব। এ মনোভাব উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেশি।
জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, যুবরা মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার, শিক্ষার অভিগমন এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধিতে সাফল্য এসেছে।
‘রাজনীতিতে অনাগ্রহ’
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এই জরিপে রাজনীতিতে যুবদের অনাগ্রহের বিষয়টিও উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতিতে আগ্রহী মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশ যুব। অন্যদিকে রাজনীতি নিয়ে অনাগ্রহী যুবদের সংখ্যা আগ্রহীদের চেয়ে তিন গুণ বেশি (৩৫ দশমিক ২ শতাংশ)। এ ছাড়া জরিপে উঠে এসেছে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ যুব জাতীয় নির্বাচনে কখনো ভোট দেননি। স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যা ৪৬ শতাংশ।
যুবদের রাজনীতি বিমুখতা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি সম্মেলনের সমাপনী পর্বের আলোচক ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় আর্থসামাজিকভাবে দেশ কোন অবস্থায় ছিল আর এখন কোন অবস্থায় রয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় জঙ্গিবাদ দেশে বড় একটি সমস্যা ছিল। এখন সেটি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। এই সম্মেলনে যেসব দাবি উঠে এসেছে, সেগুলো দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির কাছে তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি।
সরকারের কোনো নীতির বিরুদ্ধে তরুণেরা এখন সমালোচনা করতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন আরেকজন আলোচক ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। তিনি বলেন, সরকারের সমালোচনা করলে তরুণদের হেনস্তার শিকার হতে হয় বা জেলে যেতে হয়। সরকারি দলের অনুগত ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষতির মুখে পড়েন।
রাজনীতি নিয়ে তরুণদের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে বলে স্বীকার করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম বলেন, দেশের উন্নয়নে বিএনপি যা করতে পারেনি, সেটি আওয়ামী লীগ করে দেখিয়েছে। তরুণদের জন্য সরকারি-বেসরকারি এখন অনেক উদ্যোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশরেকা অদিতি হক বলেন, দেশে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে। এখন অল্প সময়ে ধনী হতে রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন অনেকে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নেই। রাজনীতির এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে হলে সমঝোতা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
আলোচনা পর্বে সঞ্চালক ছিলেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে যুবসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কতখানি যুক্ত করা গেছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, সে প্রশ্ন সামনে আসে। তরুণদের ভূমিকার রাখার সুযোগ দিতে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রয়োজন। সামনে নির্বাচন, সেখানে যুবসমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০০৮ সালের পর দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ভোটার হয়েছেন। এরপর তাঁরা হয়তো ভোট দেওয়ার পূর্ণ সুযোগ পাননি, এবার পাবেন বলে আশা করেন তিনি।