মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান সংঘাতের অভিঘাত এখন বাংলাদেশকেও আক্রান্ত করছে। পাশের দেশটির চলমান গৃহযুদ্ধ থেকে প্রাণে বাঁচতে সম্প্রতি সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক শ সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। রোহিঙ্গাদেরও আবার বাংলাদেশে চলে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাখাইন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য মিয়ানমারের সরকারের পাশাপাশি অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের বিকল্প পন্থায় নজর দেওয়া জরুরি।
আজ বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত দেন। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ ‘বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী: মিয়ানমার সংকট ও তার প্রভাব’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মিয়ানমারকে কখনো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতিতে দেশটিকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের আমরা লক্ষ করছি। এখন যেটা হচ্ছে, গৃহযুদ্ধের সরাসরি আঘাত বাংলাদেশে এসে পড়ছে। এখন আরাকান আর্মি যদি লড়াই তীব্র করে তোলে, নতুন নতুন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তার একটি অভিঘাত বাংলাদেশের ওপর পড়বে। সশস্ত্র লোকজন আমাদের এখানে আশ্রয় নিতে পারে।’
আকমল হোসেন বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্য না হলেও অপ্রকাশ্য যোগাযোগ হতে পারে। অপ্রকাশ্য অনেক আলোচনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মিয়ানমারের যে বাস্তবতা এখন তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থ সুস্পষ্টভাবে তাদের সামনে তুলে ধরা যেতে পারে। বিশেষ করে রাখাইন নিয়ন্ত্রণের শক্তি আরাকান আর্মি অর্জন করে ফেললে আমাদের তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। কোনো সুযোগ যদি আমাদের জন্য তৈরি হয়, তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে একটা উপায় বের করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এসআইপিজির জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারকে আমরা কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিইনি। আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে আরাকানের এসব লোকজনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হব সে বিষয়টি। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের আরাকানের মুসলমান হিসেবে অভিহিত করেছে। মিয়ানমারের ছায়া সরকার এনইউজি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনের অন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই বিশ্বাস আনতে হবে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের রাখাইনের অন্যদের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্যদিকে কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে অনেক শক্তির যুক্ততা থাকে। তার মানে আলোচনা অনেক সময় টেবিলের বাইরেও হতে পারে।
মিয়ানমারের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের একসঙ্গে কাজ করার প্রসঙ্গ টেনে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দিল্লি সফরের সময় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনায় মিয়ানমার নিয়ে দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টি এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি ভারতের সাহায্য চাইছে? নাকি ভারত আমাদের কাছ থেকে সাহায্য নেবে? কারণ, আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তো ভালো নয়।’
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ ওয়েবিনারে মূল বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় পরিস্থিতি, প্রান্তিক প্রদেশগুলোর পরিস্থিতি এবং আরাকানের পরিস্থিতি—এ তিনটি দিক আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। এই তিন পরিসরের ঘটনাবলির চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন তিন ধরনের উপাদান রয়েছে। যদিও সেগুলোর মধ্যে আবার আন্তসংযোগও আছে। এই তিন পরিসরের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরন বাস্তব কারণে আলাদা হওয়া দরকার। বাংলাদেশে যদিও আরাকান যুদ্ধ বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক কারণে চিন রাজ্য বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু প্রদেশটি বাংলাদেশের লাগোয়া, সেহেতু বাংলাদেশেরও তাদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগের আবশ্যকতা রয়েছে।
সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে সমাপনী বক্তৃতা দেন কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান।