স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসে যা বলেছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও মুক্তিকামী বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে দেশের সিনেটর এডওয়ার্ড টেড কেনেডি নামে পরিচিত এডওয়ার্ড এম কেনেডি। পাকিস্তান সরকারের বাধায় বাংলাদেশে আসতে না পারলেও ভারতে এসে শরণার্থীশিবির ঘুরে দেখেছিলেন দুর্দশার চিত্র, পাকিস্তানি হানাদারেরা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার বিবরণ শুনেছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মতামত তৈরিতে নিয়েছিলেন বড় ভূমিকা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসে ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন এডওয়ার্ড এম কেনেডি। যুক্তরাষ্ট্র–বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্তমানে এডওয়ার্ড কেনেডির ছেলে এডওয়ার্ড টেড কেনেডি জুনিয়রসহ তাঁর পরিবারের নয়জন সদস্য বাংলাদেশ সফর করছেন। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বটগাছতলায় গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন কেনেডি জুনিয়র। কারণ, ওই গাছের চারা রোপণ করেছিলেন তাঁর বাবা এডওয়ার্ড এম কেনেডি। ২০০৯ সালে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এডওয়ার্ড এম কেনেডি ’৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডওয়ার্ড এম কেনেডির ভাষণ
আপনাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা ও শুভাশীষ নিয়ে আমি বাংলাদেশে এসেছি। যে বিদ্যায়তনটি বাঙালির জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দু এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমনে নিপীড়কেরা প্রথম যে প্রতিষ্ঠানটিকে নিশানা করেছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরে আমি গৌরব বোধ করছি।
আমেরিকার সর্বোত্তম ঐতিহ্য হলো মানুষের মুক্তির পক্ষে দাঁড়ানো, তা বিশ্বের যেখানেই হোক না কেন। যারা স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা ও মানুষের মহৎ আকাঙ্ক্ষা পূরণে সংগ্রাম করে, তাদের পাশে থাকতে পারাকে আমেরিকার মানুষ গৌরবের বলে মনে করে। আপনারা জানেন, কিছু দেশের সরকার আপনাদের এখনো স্বীকৃতি না দিলেও বিশ্বের জনগণ আপনাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বৈরশাসন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য আপনারা যা যা করেছেন, তার সবকিছুর স্বীকৃতি তারা দিয়েছে।
স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা ভাই ভাই এবং কোনো মানুষ, কোনো নীতি ও কোনো সরকার এটা পাল্টাতে পারবে না। আমি বাংলাদেশে এসেছি সেই সব মানুষের একজন হিসেবে, যাঁরা সংগ্রামে আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কয়েক মাস আগে গত আগস্টে আমি ভারতে শরণার্থীশিবিরে থাকা বাংলাদেশিদের দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে অসহায়ভাবে বেঁচে থাকা ও মরণাপন্ন মানুষগুলোকে আমি দেখেছি। সেখানে আমি ক্ষুধার্ত শিশুদের দেখেছি। দেখেছি কীভাবে যুদ্ধের কারণে পরিবারগুলো শেষ হয়ে গেছে।
সে সময়ই আমি বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। দেশের ভেতরে কী ঘটছে, তা বিশ্ববাসী জেনে যাবে, সেই ভয় ওই সামরিক সরকার পেয়েছিল। আপনাদের দেশের মানুষ যে দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল, তাতে আমি বেদনাহত হয়েছি, যেমনটি বিশ্ববাসী হয়েছিল এবং এখন সারা বিশ্বের মতো আমিও উচ্ছ্বসিত। এই উচ্ছ্বাস পৃথিবীতে স্বাধীনতার ইতিহাসে আপনারা যে উজ্জ্বল নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন, সে কারণে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রার্থনা ছিল, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।’
মুক্তি আজ আপনাদের হাতে ধরা দিয়েছে এবং একটি নতুন বাঙালি জাতি জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার পেয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, বিশ্বের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাস শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। বাঙালি জাতির জন্ম অন্যান্য ভূখণ্ডের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। জীবন দিয়ে দেশের প্রতি আপনাদের যে ভালোবাসা এবং যে উদ্দীপনা তা সবার কাছে, বিশেষ করে যাঁরা এখনো মুক্তির দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কাছে তা প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। দুই শ বছর আগে এখান থেকে ১০ হাজার মাইল দূরে, আমেরিকার মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন। তখন তাঁরাও অন্য স্বাধীনতাযুদ্ধের তারকাদের অনুসরণ করেছিলেন। আমাদের শুরুটাও আপনাদের তুলনায় খুব অনুকূল ছিল না।
আপনাদের মতোই তৎকালীন ক্ষমতাধর ও প্রতিষ্ঠিত সরকার আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে চেয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম দিকের নেতাদেরও আপনাদের মতো ভয়ানক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আপনাদের মতোই আমাদের নতুন আমেরিকান জাতির জন্ম হয়েছিল। সেখানে এমন মানুষও ছিলেন, যাঁরা বলেছিলেন, এ রকম একটি দুর্বল ও দরিদ্র দেশ আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে না। তাঁরা ভেবেছিলেন, স্বাধীনভাবে আমাদের পথচলা নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে। আমরা তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছি। আমরা সবকিছুতে দরিদ্র ছিলাম, তবে আমাদের আশা ও সাহস ছিল।
আমাদের ধন–সম্পত্তি ছিল না, কিন্তু আমাদের অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ছিল। আমাদের সেই সব সামর্থ্যবান মানুষ ছিলেন, যাঁরা আমাদের জাতিকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। জনগণকে কোন পথে চলতে হবে, তা বাতলে দেওয়ার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ছিলেন।
আমেরিকার বিপ্লব ১৭৭৬ সালে শেষ হয়নি। ওয়াশিংটন ও জেফারসনের সঙ্গে তার মৃত্যু হয়নি। স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ এবং কালো-সাদা সব নাগরিকের সমতা নিশ্চিত করতে আমাদের যে প্রচেষ্টা, তার মধ্য দিয়ে এটা আজও বেঁচে আছে। নিপীড়নের শিকার অন্যান্য জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও এটা জীবন্ত রয়েছে।
এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম আমেরিকার বিবেককে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। এটি আমাদের অতীতের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয় এবং স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা জাতীয়তার সব ভাবনাকে ছাপিয়ে যায়, তা-ই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমেরিকার জনগণ আপনাদের পাশে ছিল, যদিও আমাদের সরকার ছিল না। চেতনাগত জায়গা থেকে আমরা এখন আপনাদের সঙ্গে আছি এবং আমেরিকার নেতারাও এখন আর পিছিয়ে থাকবেন না।
আমেরিকার প্রকৃত পররাষ্ট্রনীতি হলো নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, জনগণের সঙ্গে জনগণের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা, যা কোনো স্বৈরতন্ত্র খর্ব করতে পারে না। এদিক দিয়ে এক অর্থে, আমরা সবাই বাংলাদেশি, আমরা সবাই আমেরিকান এবং আমরা সবাই মানবতার বৃহত্তর মৈত্রীর অংশীদার। বর্তমান বিশ্বে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কাজের ক্ষেত্রে যে সবচেয়ে কার্যকর শক্তি, তা নিয়ে যাঁদের সন্দেহ আছে, তাঁদের বাংলাদেশে আসতে দিন।
আজ আমি এখানে এসেছি এটা বলতে যে আমেরিকা আপনাদের কথা ভাবে। আমি এসেছি আপনাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জানতে ও শিখতে। যাঁরা শরণার্থীশিবিরে ভয়ানক কষ্টের মধ্য দিয়ে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে আবার কথা বলতে এসেছি। এবং জানাতে এসেছি, যাঁরা বেঁচে আছেন, স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের বেদনা লাঘবে আমি ও আমার দেশের মানুষ পাশে আছি।
যদি একজন আমেরিকানের কোনো কথা আপনাদের ক্ষত নিরাময়ে কিছুটা সাহায্য করতে পারে, যদি আপনাদের নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সহাবস্থানে সহায়তা করতে পারে, তাহলে সেই কথাগুলো হলো এক শতাব্দী আগে আমাদের গৃহযুদ্ধ শেষে আব্রাহাম লিংকনের সেই বাণী।
‘কারও প্রতি বিদ্বেষ রেখে নয়, সবার প্রতি সহমর্মিতা দিয়ে, ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার রক্ষায় অবিচল থেকে এসো আমাদের করণীয়গুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করি; এসো চেষ্টা করি জাতির ক্ষতস্থান মেরামতের; স্ত্রীকে বিধবা আর সন্তানদের এতিম করে লড়াইয়ের ময়দানে শহীদ হওয়া বীরদের ভার তুলে নিতে চেষ্টা করি; আমাদের নিজেদের মধ্যে এবং গোটা জাতির মধ্যে ন্যায্যতা ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় যা যা প্রয়োজন এসো তার সবকিছু করি।’
আমেরিকার সর্বোত্তমের মূলে যে চেতনা, আমাদের সংবিধান এবং স্বাধীনতার ঘোষণার চেতনার আলোকে আমি আপনাদের মহান স্বাধীনতালব্ধ নবজন্মকে অভিবাদন জানাচ্ছি। ‘জয় বাংলা’, বাংলাদেশের জয় হোক।