ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে অসুস্থ এক ছেলেকে চিকিৎসক দেখাতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন গৃহবধূ কামরুন্নাহার (৩৫)। দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক দেখিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখেন, বুকসমান পানিতে ডুবে আছে সড়ক। মুঠোফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, ঘরেও পানি উঠেছে। অপর দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামী আটকা পড়েছেন ঘরে। হঠাৎ দেখা দেওয়া বন্যার কারণে ঘরের পরিবর্তে এক স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিতে হয় কামরুন্নাহারকে।
অনেক চেষ্টার পর আজ শুক্রবার বিকেলে বাড়িতে ফিরলেও দেখেন, ঘরের আসবাবসহ মালামাল পানিতে ডুবে রয়েছে। সন্তানদের নিয়ে স্বামী এক প্রতিবেশীর দোতলা ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। কামরুন্নাহার ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী সীমান্তবর্তী এলাকার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মান্দাকিনী গ্রামের আবুল কাশেমের স্ত্রী।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় মান্দাকিনী গ্রামের মতো একই পরিস্থিতি ফটিকছড়ির প্রায় সব এলাকায়। পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও উপজেলার অনেক রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি এখনো ডুবে রয়েছে। এদিকে বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন হাটহাজারী উপজেলারও অনেক বাসিন্দা। বন্যার পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
মান্দাকিনী গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ফটিকছড়ির সুয়াবিল ইউনিয়ন। আজ বিকেলে নাজিরহাট বাগান বাজার মূল সড়ক ধরে হাঁটুপানি মাড়িয়ে মান্দাকিনী সেতু এলাকায় গেলে দেখা যায়, সেখানে কয়েক শ মানুষের জটলা। নৌকায় করে কেউ বাড়িতে আটকে থাকা পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সহায়তা নিয়ে ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে করে এসেছেন বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।
বন্যাদুর্গত মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ব্যক্তিদের একজন চুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মুহাম্মদ রায়হান। তিনি বলেন, বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় তিনিসহ ১৫-১৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে চারটি নৌকা নামানো হয়েছে। সকাল থেকে ফটিকছড়িতেই কেবল ৩০০ মানুষকে তাঁরা উদ্ধার করেছেন।
সেতুর গোড়ায় এক শিশুকে নিয়ে একটি নৌকা থেকে নামতে দেখা যায় সুফিয়া বেগম নামের এক নারীকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি পূর্ব সুয়াবিলে। ঘরে বুকসমান পানি। খাটে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ছেলেসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য। তিনি একমাত্র নাতনিকে বিপদ থেকে বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে এসেছেন।
একই এলাকায় আনোয়ারা বেগম নামের আরেক নারী বলেন, তিনি বোনের বাসায় খাবার দিতে এসেছেন। বোনের বাড়ি বন্যায় ডুবে রয়েছে।
নাজিরহাট বাজারের একটি চা–দোকানে ৭৫ বছর বয়সী আবুল কাসেমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এমন বন্যা আগে কখনো দেখেননি। তিনি বাজারে এসেছিলেন। হঠাৎ বন্যা দেখা দেওয়ায় আর বাড়িতে ফিরতে পারেননি। রাতে বাজারে এক পরিচিত ব্যক্তির দোকানে থেকে যান।
মুহাম্মদ ইউসুফ নামের এক ব্যক্তি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাজারের একটি দোকানে। তিনি বলেন, ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন। চিড়া খেয়ে দিন পার করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে তিন দিন ধরে পর্যায়ক্রমে ফটিকছড়ির ১৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার পর থেকে পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো উত্তর ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকা এবং নাজিরহাট পৌর এলাকার দিকে কোথাও বুক, কোথাও কোমরসমান পানি। বসতঘর, সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবকিছুই ডুবে রয়েছে।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাত তিনটার পর থেকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। দেড় থেকে দুই ফুট পানি কমেছে। স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুসহ ফটিকছড়িতে দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানান ইউএনও।
এদিকে হাটহাজারী উপজেলার ফটিকছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায় বৃহস্পতিবার হালদা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে।
ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলম প্রথম আলোকে বলেন, রাতে হঠাৎ হালদার নাজিরহাট নতুন ব্রিজ অংশে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এরপর নদীর পানি ঢুকে তাঁর ইউনিয়নের লন্ডভন্ড অবস্থা। ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, বন্যাকবলিত ঘরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মুহাম্মদ সাকিব (২২) নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।