ফেরি ভাড়া দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিসি
বিআইডব্লিউটিসির আহ্বায়ক কমিটি ফেরি ও পন্টুন ভাড়া দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমতি সাপেক্ষে দ্রুত ভাড়া দেওয়া হবে।
বেসরকারি খাতে প্রথমবারের মতো ফেরি ভাড়া দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। এসব ফেরিতে ভোলা থেকে ঢাকায় গ্যাস পরিবহন করা হবে। বিষয়টি এখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র বলছে, কাজ না থাকায় প্রতিদিন অন্তত ১০টি ফেরি বসে থাকে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে দ্রুত ফেরি ভাড়া দেওয়া হবে।
তবে ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি পক্ষ বলছে, ফেরি বসিয়ে না রেখে ভাড়া দিলে ভাড়াও পাওয়া যাবে, আবার ফেরিও ভালো থাকবে। তবে অন্য পক্ষের মত—ফেরিসহ অন্যান্য নৌযান ভাড়া না দিয়ে করপোরেশনের নিজেদের চালানো উচিত। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে এসব ফেরি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। তাই ভাড়া দেওয়া ফেরির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। এমনকি ফেরি গায়েবও হয়ে যেতে পারে।
নৌযান বসিয়ে না রেখে ভাড়া দিলে প্রতি মাসে টাকা আসবে। তবে ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ মানের চুক্তি করতে হবে এবং সেই চুক্তি বাস্তবায়নও করতে হবে।প্রণয় কান্তি বিশ্বাস, সাবেক চেয়ারম্যান, বিআইডব্লিউটিসি
নৌযান বসিয়ে না রেখে ভাড়া দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভাড়া দিতে যথাযথ মানের চুক্তি করতে হবে এবং সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিআইডব্লিউটিসির কাছ থেকে ফেরি ও পন্টুন ভাড়া নিতে যাচ্ছে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের গ্যাসের ব্যবসা রয়েছে। ভোলা থেকে গ্যাস সিলিন্ডারজাত করে শিল্পে ব্যবহারের জন্য ফেরিতে করে তা ঢাকায় নেবে ইন্ট্রাকো।
ফেরি ও পন্টুন ভাড়া চেয়ে ইন্ট্রাকো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় গত ১০ জানুয়ারি বিআইডব্লিউটিসিকে নির্দেশনা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (মেরিন) ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ হাসেমুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে ফেরি ও পন্টুন ভাড়া দেওয়ার পক্ষে মত দেয় সেই কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২ মে দুটি ‘ইম্প্রুভড মিডিয়াম ফেরি’ (মাঝারি ধরনের) এবং দুটি রো রো পন্টুন প্রাথমিকভাবে এক বছরের জন্য ইন্ট্রাকোর কাছে ভাড়া দেওয়ার সম্মতির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি।
গ্যাসবাহী ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে এসব ফেরিতে পরিবহন করতে পারবে না ইন্ট্রাকো। তারা ফেরি বা পন্টুন তৃতীয় পক্ষের কাছেও ভাড়া দিতে পারবে না।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত নতুন ফেরি বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালসহ মোট আটটি মাঝারি ধরনের ফেরি রয়েছে। এর মধ্য থেকে দুটি ভাড়া দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমতি সাপেক্ষে বিআইডব্লিউটিসির নৌযান চার্টার নীতিমালার আওতায় এই চুক্তি হবে।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, ইন্ট্রাকোর কাছে ফেরি ও পন্টুন এক বছরের জন্য মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হতে পারে। গ্যাসবাহী ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি বাণিজ্যিকভাবে এসব ফেরিতে পরিবহন করতে পারবে না ইন্ট্রাকো। তারা ফেরি বা পন্টুন তৃতীয় পক্ষের কাছেও ভাড়া দিতে পারবে না। ইন্ট্রাকো ভাড়া নিলেও জনবল দেবে বিআইডব্লিউটিসি। ফেরির জ্বালানি খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। ফেরি ও পন্টুন মেরামতের দায়িত্ব ইন্ট্রাকোকে নিতে হবে। ফেরি দুর্ঘটনাকবলিত হলে ইন্ট্রাকো ক্ষয়ক্ষতির দায় নেবে।
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ভাড়া দেওয়ার অনুমোদন পেতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত পেলে যত দ্রুত সম্ভব ভাড়া দেওয়া হবে। করপোরেশনের কাছে বাড়তি ফেরি থাকা সাপেক্ষে তাদের (ইন্ট্রাকো) যে কয়টা ফেরি লাগে, সে কয়টা ভাড়া দেওয়া হবে।
পক্ষে–বিপক্ষে মত
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মাওয়া ঘাটকেন্দ্রিক ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেসব ফেরি পরবর্তী সময়ে বিআইডব্লিউটিসির অন্য ঘাটে যুক্ত হয়। ফলে বর্তমানে যা চাহিদা, তার চেয়ে বেশি ফেরি রয়েছে সংস্থাটির বহরে। কাজ না থাকায় প্রতিদিন অন্তত ১০টি ফেরি বসে থাকে। সংস্থাটির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের একটি পক্ষ বলছে, ফেরি বসিয়ে রাখলে ফেরি অকেজো হয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যেসব সংগঠন রয়েছে, তার মধ্যে ‘বিআইডব্লিউটিসি এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন’ ফেরিসহ কোনো নৌযান ভাড়া দেওয়ার বিপক্ষে। ফেরি ভাড়া না দিতে সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠিও দিয়েছে তারা।
ভাড়া দেওয়ার অনুমোদন পেতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত পেলে যত দ্রুত সম্ভব ভাড়া দেওয়া হবে। করপোরেশনের কাছে বাড়তি ফেরি থাকা সাপেক্ষে তাদের (ইন্ট্রাকো) যে কয়টা ফেরি লাগে, সে কয়টা ভাড়া দেওয়া হবে।বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমান
এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন বলছে, নৌযান ভাড়া দিলে তা ফিরিয়ে এনে চালানো সম্ভব হয় না। অতীতে কার্গো, স্টিমার, ওয়াটারবাসসহ নানা নৌযান ভাড়া দিয়ে দেখা গেছে, ভাড়া নেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নৌযানের যন্ত্রাংশ ও মালামাল, ডেক ইত্যাদি পরিবর্তন করে, চুরি করে, এমনকি অকেজো করে দেয়। এমনও দেখা গেছে, ভাড়া নেওয়া পক্ষ নৌযানের রং পরিবর্তন করে তা গায়েব করে দিয়েছে। তা ছাড়া নিয়মিত ভাড়া না দেওয়া প্রায় নিয়মিত ঘটনা, যা অনেক ক্ষেত্রে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। এ অবস্থায় ফেরি ভাড়া দেওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
ফেরি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে করপোরেশনের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দুটি পক্ষের বক্তব্যেরই যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করেন বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রণয় কান্তি বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নৌযান বসিয়ে না রেখে ভাড়া দিলে প্রতি মাসে টাকা আসবে। তবে ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ মানের চুক্তি করতে হবে এবং সেই চুক্তি বাস্তবায়নও করতে হবে। যদি ভালো চুক্তি করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে সরকারের মূল্যবান সম্পদ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।’