শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে ভোগান্তি, সেবা না পেয়েই ফিরছেন অনেকে

সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিমকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমফাইল ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের (রেজিস্ট্রার বিল্ডিং) তিনতলায় একটি কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দুই নারী। তাঁরা এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে।

গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা মা-মেয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন মেয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন। একাডেমিক কাগজপত্র সত্যায়িত করা ও ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’ নেওয়ার জন্য এসেছেন। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজটি করে দিচ্ছেন না।

পরে কক্ষের ভেতরে একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, কর্মবিরতির কারণে সেবা দিতে পারছেন না। সমিতির নেতারা কাজ বন্ধ রাখতে বলেছেন।

ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে না। প্রশাসনিক ভবনেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেকেই সনদসংক্রান্ত কাজসহ বিভিন্ন সেবা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

ওই ভবনের অধিকাংশ কক্ষেই তখন তালা ঝুলছিল। কোনো দপ্তরের সামনে কর্মবিরতি লেখা একটি কাগজ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেবা নিতে আসা মানুষও নগণ্য।

প্রশাসনিক ভবনের নিচে এসে দেখা যায়, ভবনের সামনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিছিল চলছে। কিছু দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে শিক্ষকদের জমায়েত।

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিলসহ তিনটি দাবিতে সারা দেশে ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে এই সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। দেশে বর্তমানে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম রয়েছে। তবে কর্মবিরতি চলছে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একজন নেতা জানান, এই আন্দোলনটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পুরোপুরি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। আবার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি নেই। ফলে সেগুলোতে সরাসরি কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। তবে দাবির প্রতি সবার সমর্থন আছে।

যোগাযোগ চলছে। তবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক ভূঁইয়া

চলমান আন্দোলনের অষ্টম দিন ছিল গতকাল। এই কর্মসূচির কারণে তালা ঝুলছে শ্রেণিকক্ষ ও অফিসে। ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে না। প্রশাসনিক ভবনেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেকেই সনদসংক্রান্ত কাজসহ বিভিন্ন সেবা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

গতকাল কমবেশি একই চিত্র দেখা গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কর্মবিরতি চলবে। এ রকম পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষায় আবারও সেশনজট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আন্দোলন চলছেই

অন্য দিনের মতো গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে জমায়েত হন শিক্ষকেরা। সেখানে বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লড়াই করছেন। তিন দফা দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা আছেন এবং থাকবেন।

দাবির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা বৈঠক হওয়ার খবর আছে কি না, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক ভূঁইয়া গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, যোগাযোগ চলছে। তবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

আরও পড়ুন

সনদ নিতে এসে ফিরে গেছেন অনেকেই

প্রথম আলোজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনিক এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ বন্ধ রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী তাঁদের সনদ নিতে এসে ফিরে গেছেন।

গতকাল দুপুর সোয়া ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সামনে কথা হয় কয়েকজন সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, স্নাতকোত্তরের সনদ তোলার জন্য এসেছিলেন। তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন দাপ্তরিক কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে তাঁরা সনদ না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন।

তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মনিকা আক্তার। তিনি জানালেন, জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেয়েছেন। তাঁকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে মূল সনদের কপি পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে। যেটি জাপানে পাঠাতে অন্তত পাঁচ দিন সময় প্রয়োজন। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এসে সবকিছু বন্ধ পেয়ে ফিরে গেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কোনো কক্ষে তালা দেওয়া রয়েছে। কেউ কেউ বসে গল্প করছেন।

আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের একজন অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বলেন, তাঁদের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তবে বিদ্যুৎ, পানি ও চিকিৎসাকেন্দ্রে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সেবা চলমান।

প্রথম আলোরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সনদ শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সনদ তুলতে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সহায়তা করতে পারছেন না। শুধু প্রাথমিক তথ্য ও করণীয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রণব কুমার পান্ডে প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনিক ভবনের দপ্তরগুলো খোলা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো কাজ করছেন না। মানুষ আসছেন, তাই দপ্তরগুলো খোলা রাখা হয়েছে।

প্রথম আলোচট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্লাস-পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কার্যক্রমসহ সব ধরনের কাজ থেকে বিরত রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী বর্ষের (২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ) প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী সাময়িক সনদ তুলতে পারছেন না।

 সমাপনী বর্ষের মেকাট্রনিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইমনুল হক বলেন, দেড় মাস আগে তিনি সব একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করেছেন। কিন্তু সাময়িক সনদ তুলতে না পারায় বিদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারেননি। চাকরিতেও আবেদন করা যাচ্ছে না।