৯ মাসে দুই বিস্ফোরণ, আতঙ্কে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরের বাসিন্দারা

সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের সময় ভেঙে যাওয়া কেশবপুরের একটি ঘরের জানালা। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

দরজা-জানালা ভেঙে গেছে অধিকাংশ ঘরে। কয়েকটি ঘরের দেয়ালেও দেখা দিয়েছে ফাটল। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় ঢুকলেই চোখে পড়ছে এমন দৃশ্য। গত শনিবার বিকেলে এলাকাটির সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব বসতঘর।

এর আগে গত বছরের ৪ জুন ওই ইউনিয়নে অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের সময়ও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন কেশবপুরের বাসিন্দারা। ৯ মাসের মাথায় একই ধরনের বিস্ফোরণে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এলাকাবাসীর দাবি, লোকালয়ের পাশে অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে কারখানায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আরও পড়ুন

যেমন দেখা গেল কেশবপুর

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কেশবপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটিতে বসবাস করে প্রায় ৫০০ পরিবার। গ্রামের উত্তর দিকে বিএম কনটেইনার ডিপো, দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সীমা অক্সিজেন কারখানা। এ ছাড়া আরও অন্তত ১০টি শিল্পকারখানা রয়েছে গ্রামটির আশপাশে।

কেশবপুরের আবদুল মালেক সেরাং জামে মসজিদের সামনে গিয়ে চোখে পড়ে মসজিদের কাচ লাগানোর কাজ করছেন কয়েক শ্রমিক। তাঁরা জানান, সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের সময় মসজিদের সব কটি কাচের জানালা ভেঙে গেছে। তাই নতুন করে কাচ লাগানোর কাজ করছেন তাঁরা। এর আগে বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার সময়ও মসজিদটি একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

জাহিদুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির ঘরে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ঘরের সেগুন কাঠের দরজার একপাশ খুলে পড়ে গেছে। বাকি অংশটিতেও দেখা দিয়েছে ফাটল। এ ছাড়া তাঁর ঘরের প্রায় প্রতিটি জানালার কাচ ভেঙে গেছে।

আরও পড়ুন

জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকট শব্দে বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে দরজা ও জানালা ভেঙে যায়। আমরা খুবই আতঙ্কিত ছিলাম। বিস্ফোরণে ঘরের অন্তত পাঁচ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

রফিকুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁর দোতলা ভবনটি কেঁপে ওঠে। ঘরের সব জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। কারখানা থেকে একটি লোহার পাত উড়ে এসে তাঁর উঠানে পড়ে। লোহার পাতের আঘাতে তিনটি সুপারিগাছ ভেঙে গেলেও উঠানে খেলতে থাকা শিশুরা রক্ষা পান। তিনি বলেন, বছর না ঘুরতেই দুটি বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকাবাসী খুবই আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন।

আরও পড়ুন

ট্রমায় শিশুরা

বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার ঘটনার রেশ না কাটতেই আবারও একই ইউনিয়নের সীমা কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় ট্রমায় ভুগছেন এলাকার শিশুরা। কেশবপুরের কোহিনুর বেগম নামের এক গৃহবধূ জানান, গত শনিবারের বিস্ফোরণের পর থেকেই তাঁর দুই সন্তান সিফাত হোসেন (৫) ও সানজিদা আক্তার (১৫) রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। রাতে একাধিকবার চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায় তারা। ঘুম ভাঙলে খাটের ওপর বসে কান্না করে।

নুরজাহান বেগম নামের অপর এক নারী বলেন, দুর্ঘটনার সময় কারখানার কাছাকাছি একটি মাঠে খেলা করছিল তাঁর দুই সন্তান। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর হইচই শুরু হয়। তিনি দৌড়ে গিয়ে মাঠ থেকে ছেলেমেয়েদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁর সন্তান দুজন এর পর থেকে সব সময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। রাতে ঘুম ভেঙে যায় তাদের।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুর উদ্দীন রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় বিস্ফোরণে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক অনেকেই ট্রমায় ভুগতে পারেন। ট্রমাসহ দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার সার্বিক খোঁজখবর নিতে শিগগিরই একটি চিকিৎসক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে।

আরও পড়ুন

ক্ষতিপূরণ চান বাসিন্দারা

সীমা অক্সিজেন কারখানার বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন। কেশবপুরের বাসিন্দারা জানান, এলাকার কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনায় জনবসতির ক্ষতি হলেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ কম হওয়ায় অনেক বাসিন্দা তা না নিয়ে ফেরত দিয়েছেন।

ইসমাইল হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ডিপো বিস্ফোরণে তাঁর ক্ষতি হয়েছিল ১৫ হাজার টাকার মতো। তাঁকে এক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চাওয়ায় তিনি তা নেননি। এবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পেলে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইয়াকুব আলী বলেন, সীমা অক্সিজেন কারখানায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ আদায়ে আশাবাদী তিনি। এর আগে বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর।

আরও পড়ুন

শিল্পকারখানা সরানোর দাবি

শিল্পকারখানার পাশে বসতঘর হওয়ায় সব সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় থাকেন কেশবপুরের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, শিল্পকারখানাগুলোকে জনবসতি থেকে দূরে নিয়ে যেতে হবে। তা সম্ভব না হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

ইলিয়াস মাহমুদ নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাবাসী পরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পক্ষে। এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানা স্থানান্তর করা না গেলে তাঁদের যাতে অন্তত মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত ও অন্তত ২৪ জন আহত হন।