বাংলাদেশের চাহিদার আলোকে ভারতের চাহিদাকে দেখতে হবে: হোসেন জিল্লুর

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান ‘অভিন্ন নদীর পানি ও ভারত প্রশ্ন: সমাধানের রাজনীতি কী?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১৫ নভেম্বরছবি: আশরাফুল আলম

ভারতের চাহিদা বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভারতের কী চাহিদা, সেটা কিন্তু আমাদের প্রথম পাঠ হতে পারে না। প্রথম পাঠ হতে হবে বাংলাদেশের চাহিদাগুলো কী। সেই চাহিদার আলোকে ভারতের চাহিদাকে দেখতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে।’

‘অভিন্ন নদীর পানি ও ভারত প্রশ্ন: সমাধানের রাজনীতি কী?’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় হোসেন জিল্লুর রহমান এ কথাগুলো বলেন। আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে ইউনিটি ফর বাংলাদেশ।

ভারত নিয়ে বাংলাদেশিদের মনোজগতে প্রচণ্ড একটা পরিবর্তন আনা দরকার বলেও মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি ভারতকে ‘বৃহৎ প্রতিবেশী’ রাষ্ট্র বলার বিপক্ষে। তাঁর মতে, ‘বৃহৎ’ শব্দটার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক বার্তা যায়। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে তা নিয়ে দ্বিমত নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেকোনো স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্র সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে।

ভারতের আধিপত্যবাদিতাকে বাস্তবতা উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই বাস্তবতার বিভিন্ন উদাহরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি—অসম চুক্তি, অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক। নির্বাচনে হস্তক্ষেপটা চূড়ান্ত ছিল। আরও একটা বড় বিষয় হচ্ছে নীতি গ্রহণের সার্বভৌমত্ব—এটা আমরা নীরবে বিসর্জন দিয়েছি।...ভারতকে গালাগালি করে নিজেদের ভুল অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন শক্তির জায়গায় পুনর্গঠন করতে চাইলে প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে নিজেদের সক্ষমতা তৈরি করা।’

‘অভিন্ন নদীর পানি ও ভারত প্রশ্ন: সমাধানের রাজনীতি কী?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। ঢাকা, ১৫ নভেম্বর
ছবি: আশরাফুল আলম

জিল্লুর রহমানের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দুর্বলতা হলো তারা (সরকার) বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা ধারণ করছে, কিন্তু মাধ্যম বেছে নিয়েছে ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিকতা। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র দরকার, কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার শিকড় উপড়ে না ফেললে এই অবস্থায়ই থাকবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, মৌলবাদের উত্থান—এসব বিষয়ের কথা বলে বাংলাদেশে একটি দলকে অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় রেখে ভারত তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাইলে নতুন অ্যাখ্যান তৈরি করতে হবে। পারস্পরিক সম্মানবোধ, পরস্পরের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং হস্তক্ষেপ করা যাবে না—এই তিন বিষয়কে ভিত্তি ধরে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কাজ করেনি। এত বড় দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার সক্ষমতা ছোট দেশের থাকে না। পানির মতো আঞ্চলিক সমস্যাগুলোয় চীনসহ সব অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে আঞ্চলিকভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সংস্কার আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার পর থেকে ভারত বিষয়ে বাংলাদেশ মোটাদাগে দুটি নীতি অনুসরণ করে আসছে। হয় ভারতের প্রতি আনুগত্য, নয়তো ভারতবিরোধিতা। এই দুই নীতি থেকে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধান হবে না, সার্কের পুনর্গঠনের মাধ্যমে এমন জোটের মতো আঞ্চলিক শক্তির ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশের আন্তসীমান্ত নদী ৫৬টি নয়, ১২৩টি বলে দাবি করেন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন। আন্তসীমান্ত নদীগুলো থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে চাইলে প্রতিটি নদীর জন্য আলাদা চুক্তি করলে হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ–ভারতের সঙ্গে সর্বোচ্চ তিনটি চুক্তি হতে পারে—গঙ্গাভিত্তিক, ব্রহ্মপুত্রভিত্তিক ও মেঘনাভিত্তিক চুক্তি।

আলোচনা সভায় ধারণাপত্র তুলে ধরেন আফিফা রাজ্জাক। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানিবণ্টনের চুক্তিগুলো ‘অনেকটাই দায়সারা’ বলে ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক দীপ্তি দত্ত, সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন ও রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউনিটি ফর বাংলাদেশের মুখপাত্র মঞ্জুর মঈদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অনিক রায়।