‘ঢাকায় আইসাই ময়লার কাম পাইয়া গেছি’

  • অর্থনৈতিক দুর্দশা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংসার চালাতে না পেরে শিশুদের কাজে পাঠাচ্ছে পরিবার।

  • বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে শিশুরা।

শিশুপ্রতীকী ছবি

রাজধানীর মিরপুরের ভাষানটেক বাজার থেকে প্রায় এক শ গজ দূরে একটি আস্তাকুঁড়। ৭ অক্টোবর গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কয়েকটি শিশু-কিশোর কাজ করছে। কেউ ভ্যানগাড়ি থেকে ময়লা নামাচ্ছে, কেউ পুরোনো প্লাস্টিক পণ্য বাছাই করছে।

সবচেয়ে ছোট শিশুটির নাম সাগর হোসেন। বয়স ১৩ বছর। বাড়ি সুনামগঞ্জে। সাগর জানায়, মা–বাবা ও তিন ভাই-বোন মিলে ওদের পাঁচজনের পরিবার। মাস ছয়েক আগে ওদের বাবা ওদের নিয়ে ঢাকায় এসেছেন কাজের খোঁজে। এই বয়সে স্কুল ছেড়ে কাজে কেন—এই প্রশ্নে সাগরের উত্তর, ‘আয়পাতি না থাকলে খামু কী আর পরমু কী! গেরামে কাম নাই। তাই শহরে আইসি। ঢাকায় আইসাই ময়লার কাম পাইয়া গেছি।’

সাগর সেই সব শিশুর একটি, যারা নতুন করে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। গবেষণা বলছে, শিশুশ্রম সমস্যাটি বাংলাদেশে আগে থেকেই প্রকট ছিল। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়া এবং পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বহু পরিবার শিশু-কিশোরদের শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করার কথা বলা হয়েছে। যদিও শিশুশ্রম বাড়ছে।

শিশুশ্রম নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ করেছে ২০২২ সালে। ‘জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় গত মার্চে। এতে বলা হয়, গত ১০ বছরে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮৬ হাজার। শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ ৩৭ হাজার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ১০ লাখের বেশি শিশু। যেসব কাজে শিশুদের শারীরিক ও অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সেগুলোকে সরকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকাভুক্ত করে। ২০২২ সালে ৪৩ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ফেলা হয়।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত দুই সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় শ্রমে নিযুক্ত ২০টি শিশু ও তাদের কয়েকটির পরিবারের কথা বলা হয়। তাদের প্রায় সবাই বলেছে, তাঁরা শিশুদের কাজ করতে পাঠিয়েছেন অর্থনৈতিক চাপে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটির পড়াশোনায় মনোযোগ নেই বলে পরিবার কাজে পাঠিয়েছে। তবে অর্থনীতিই এ ক্ষেত্রে মূল কারণ।

ভাষানটেকের আস্তাকুঁড়ে ‘ময়লার কাজে’ পাওয়া গেল সাগরের বাবা নবী হোসেনকেও। গ্রামে তিনি রিকশা চালাতেন। এখন তিনি ও তাঁর ছেলে মিলে কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকার মতো আয় করেন। ময়লা থেকে বাছাই করা পুরোনো প্লাস্টিক পণ্য বিক্রি করে আয় হয় আরও ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।

নবী হোসেন তাঁর আরেক ছেলেকে (৯ বছর) একটি দোকানে কাজে দিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘তিন বাপ–বেটা কাজ কইরাও তো কূলকিনারা করতে পারতেছি না। এখন ওরা পড়ালেখাত গেলে সংসার চলব কেমনে, পড়ার খরচ চালামু কেমনে?’

১২ ঘণ্টা কাজ, মজুরি ১০০ টাকা

মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের একটি ভাতের হোটেলে মাসখানেক আগে কাজ শুরু করেছে সোহেল (ছদ্মনাম)। বয়স ১১ বছর। সে ঢাকার দোহার উপজেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত। তার ভাই তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে কাজ করানোর জন্য।

সোহেল জানায়, তাকে সকাল ছয়টায় কাজে আসতে হয়। ফিরতে পারে সন্ধ্যা ছয়টার পরে। সে হোটেলের গ্রাহকদের পানি সরবরাহ করে। দিনে তাকে দেওয়া হয় ১০০ টাকা। সকাল ও দুপুরে খাবার দেওয়া হয়। তবে তাকে নিয়মিত ধমক শুনতে হয়।

কাজ করতে ভালো লাগে কি, জানতে চেয়েছিলাম সোহেলের কাছে। সে বলল, ‘কিচ্ছু করার নাই। কাম করতেই অইব।’

বিবিএসের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকেরা সপ্তাহে গড়ে ২৭ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় কাজ করে। বেশির ভাগ শিশুর মাসিক আয় আড়াই থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকার মধ্যে। শিশুদের কাজে নিযুক্ত করলে স্বল্প মজুরি দেওয়া সম্ভব। খাটানো যায় বেশি। তাই তাদের নিয়োগে আগ্রহী থাকেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ছোট কারখানার মালিকেরাও।

নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেক শিশুই ভাষানটেকের ধামালকোট আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিজাম উদ্দিন খান ২০১৯ সাল থেকে দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। ২০১৯ সালে বিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ১৩০ জন শিক্ষার্থী। ২০২৪ সালে সংখ্যাটি নেমেছে ৫৪–তে। মোটামুটি একই অবস্থা অন্যান্য শ্রেণিতেও।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর  তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল ১ কোটি ৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। ২০২৩-এ এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৪ লাখে। অর্থাৎ ৯ দশমিক ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী কমেছে। 

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

শিশুশ্রম নিয়ে আইন আছে। বাস্তবায়ন নেই। আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট শিশুকে নিয়োগ করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় জানালার গ্রিল তৈরির কারখানায় কাজ করা শিশুদের একটির বয়স ১৩ বছর। সে গ্রিল ঝালাই করছিল। ঝুঁকির কথা বলায় হেসে উড়িয়ে দিল সে। বলল, কত মানুষ কত কঠিন কাজ করে। এটা আর এমন কী।

‘লক্ষ্যপূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই’

শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের কিছু কিছু উদ্যোগ আছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। উপজেলা পর্যায়েও কমিটি আছে। তবে কার্যক্রম সামান্য। সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম পুরোপুরি নিরসন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নির্মূলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শিশুশ্রম কার্যত বাড়ছে।

এডুকো বাংলাদেশের শিশুশ্রম নির্মূলবিষয়ক ব্যবস্থাপক আফজাল কবির প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কার্যক্রম সীমিত। ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যপূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রম দূর করার লক্ষ্যও পূরণ হবে না। তিনি বলেন, শিশুশ্রম দূর করতে দৃশ্যমান কাজ কম।