পর্যটন খাতে বড় ধাক্কা
৬০ শতাংশ ছাড় দিয়েও ফাঁকা পড়ে আছে হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। ৮ দিনে শুধু কক্সবাজারেই ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
দেশের পর্যটনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজার। সাড়ে পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে এখানে। এসব হোটেলে দিনে ধারণক্ষমতা দুই লাখের বেশি। দিনে লাখো পর্যটকের সমাগম থাকে ছুটির দিনগুলোয়। এখন সব হোটেল-মোটেল খালি পড়ে আছে। বিক্রি নেই তিন হাজারের বেশি দোকান ও পাঁচ শতাধিক রেস্তোরাঁয়। সৈকতের আশপাশে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটও বন্ধ হয়ে পড়েছে।
জুলাই মাসের শুরু থেকেই ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে শঙ্কা তৈরি হয় পর্যটন খাতে। এরপর সংঘর্ষ শুরু হলে একে একে বাতিল হতে থাকে সব বুকিং। এরপর শুরু হয় কারফিউ। এমন অবস্থায় লোকসানে পড়েছেন ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল-মোটেল রেস্তোরাঁসহ সংশ্লিষ্ট শতাধিক খাতের উদ্যোক্তারা। বিদেশি পর্যটকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা মহামারির পর আবার বড় ধাক্কা খেয়েছে পর্যটন খাত। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব), অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ (আটাব), প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেকোনো দুর্যোগে সবার আগে প্রভাব পড়ে পর্যটন খাতে, আবার এ খাত পুনরুদ্ধারও হয় সবার পরে। পুরো খাত এখন বিপদগ্রস্ত। গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি, ট্রেন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাড় দিয়েও পর্যটক টানতে পারছে না হোটেল-রিসোর্টগুলো। পর্যটনের সঙ্গে ১১৯টি খাত জড়িত। তাই টাকার অঙ্কে এই খাতের ক্ষতি নিরূপণ করা কঠিন।
টোয়াবের সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কা মোটামুটি কাটিয়ে ওঠার পর এখন নতুন করে বড় ধাক্কা এসেছে পর্যটন খাতে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ বাতিলের বিষয়ে আলোচনা করা যায়নি। আগে থেকে বুকিং করা সব ট্রিপ বাতিল হয়েছে। নতুন করেও কেউ ট্রিপ বুকিং করছে না।
কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। ১৫ জুলাই সংঘর্ষ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর এটা ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের বাইরে। ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে দেশে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ এখনো চলছে দিনে কয়েক ঘণ্টা শিথিল রেখে। এতে মানুষ আপাতত বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারছেন না।
টোয়াবের সদস্যরা বলছেন, করোনার প্রভাবে টানা দুই বছর মন্দা ছিল পর্যটন খাতে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের প্রথম বছর কার্যত বন্ধ ছিল পর্যটন। এরপর গত দুই বছরে করোনার ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। এখন দেশের চলমান পরিস্থিতি আবার অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে ভ্রমণ পরিচালনা করে মেঘদূত ট্যুরিজম। তারা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকায় পর্যটকেরা যোগাযোগ করতে পারছেন না। আবার পুরোনো বুকিং বাতিল করছেন ফোন করে। আগামী ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট রাঙামাটি ও সাজেকে ১২০ জনের একটা ট্রিপ ছিল। তারা ইতিমধ্যে সেটি বাতিল করেছে।
বাতিল হচ্ছে হাউসবোটের বুকিং
দেশে বেড়ানোর জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটা, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন। রাঙামাটি, সাজেক, শ্রীমঙ্গল, সিলেট এলাকার রিসোর্টগুলো বসে আছে কাজ ছাড়া।
দেশের মধ্যে পর্যটনের নতুন গন্তব্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। এখানে হাউসবোটে ভ্রমণ করতে আসেন পর্যটকেরা। বছরে মূলত চার মাস বাণিজ্য হয় এখানে। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জুলাই ও আগস্টে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন এখানে। এবার সব বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন হাউসবোট উদ্যোক্তারা। তিন শতাধিক হাউসবোট আছে এখানে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে পাঁচটি হাউসবোট পরিচালনা করে অভিযাত্রিক। এ সংস্থার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা নেহার সারওয়ার বলেন, বন্যার কারণে জুনে পর্যটক আসেননি। আর জুলাইয়ে সব বাতিল হয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে। এখন তো নতুন বুকিং হচ্ছে না। আগস্টের বুকিংও বাতিল করছেন কেউ কেউ।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০ জুলাই থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ৮ দিনে কক্সবাজারের পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, এখন শহরে কোনো পর্যটক নেই। কেবল হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর হিসাব করলেও দিনে গড়ে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।