আপিল শুনানিতে সাজার রায় বাতিল চাইলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা

সুপ্রিম কোর্টফাইল ছবি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করে পুরো সাজার রায় বাতিলের আরজি জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবীরা। এ মামলায় সাজার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানিতে আজ বুধবার তাঁর আইনজীবীরা এই আরজি জানান। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ আজ দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি গ্রহণ করেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে।

শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, ট্রাস্টের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া সই করেছেন—এমন কোনো নথি প্রসিকিউশন দেখাতে পারেনি। টাকা কোথা থেকে এসেছে, তাও দেখাতে পারেনি। আর যে অর্থের কথা বলা হয়েছে, তা ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত আছে। বিচারে সংবিধান ও আইন অনুসরণ করা হয়নি, তাই ‘বিচার কলুষিত’ হয়েছে। মামলাটি আইনগত, মৌখিক, এমনকি শোনা সাক্ষ্য–প্রমাণহীন। আর কোনো ধরনের সাক্ষ্য–প্রমাণহীন মামলায় মুখ্য আপিলকারীর (খালেদা জিয়া) ক্ষেত্রে দণ্ড ও সাজা বাতিল হলে অন্য যাঁরা আপিল করেননি, তাঁরাও এর সুবিধা (খালাস) পেতে পারেন বলে নজির রয়েছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ করে এবং সাজা ১০ বছর বাড়িয়ে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ খালেদা জিয়া পৃথক দুটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে আদেশ দেন। পাশাপাশি সাজার রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার করা পৃথক আপিলের ওপর গতকাল শুনানি শুরু হয়।

আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, এম বদরুদ্দোজা, মো. রুহুল কুদ্দুস ও কায়সার কামাল শুনানিতে অংশ নেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন জাকির হোসেন ভূইয়া, মাকসুদ উল্লাহ প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আসিফ হাসান।

এতগুলো বছর কে দেবে

আপিলকারী (খালেদা জিয়া) ট্রাস্ট পরিচালনা করেছেন বা ব্যাংক হিসাব খুলেছেন, এমন কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ নেই বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। আপিল মঞ্জুর করার আরজি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো বিচার কলুষিত হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক মামলা। এত বছর জেল, তিনি ও তাঁর পরিবারকে অপমান করা হলো। সাক্ষ্য–প্রমাণ কী? জেল খেটেছেন, চিকিৎসা করাতে পারেননি। বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতিও পাননি। বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। এই বছরগুলো কে দেবে?’

‘বিচার কলুষিত’

শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বলেন, সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনের সময় বলবৎ ছিল—এমন আইন ভঙ্গ করার অপরাধ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না উল্লেখ রয়েছে। অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অর্থাৎ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময় ধরা হয়েছে। অথচ ২০০৪ সালের দুদক আইনে খালেদা জিয়ার বিচার করা হয়। এ আইনটি ২০০৪ সালের ৯ মে কার্যকর হয়। এই আইনে বিশেষ জজ আদালত বিচার করেন। অথচ এ আইনে বিচার করতে পারেন না। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের ক্ষেত্রে ৩৫(১) অনুচ্ছেদের গুরুতর লঙ্ঘন হয়েছে। যে কারণে ‘বিচার কলুষিত’ হয়েছে। মুখ্য আপিলকারীর ক্ষেত্রে ৩৫(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হলে সামগ্রিকভাবে পুরো বিচারপ্রক্রিয়া এখতিয়ারবহির্ভূত হয়। এ ক্ষেত্রে যাঁরা আপিল করেননি, তাঁরাও এর সুবিধা পান অর্থাৎ খালাস পান, এমন নজির রয়েছে। জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, অতীতে বিদেশ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য অনেকের কাছে অনুদান হিসেবে অর্থ এসেছে, দুদক তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো মামলা করেনি। শুধু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে মামলা করে, যা বৈষম্যমূলক।

খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, টাকা কোথা থেকে এসেছে, কাকে দেওয়া হয়েছে, তা দেখাতে পারেনি প্রসিকিউশন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ–সংক্রান্ত নথি পাওয়া যায়নি এবং ব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন নথি খুঁজে পাননি না—সাক্ষীদের বক্তব্যে এসেছে। তাহলে কি অভিযোগ প্রমাণিত হয়? মামলাটি আইনগত, মৌখিক, এমনকি শোনা সাক্ষ্য–প্রমাণহীন। অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কেনা হয়েছে এবং বাকি টাকা ব্যাংকে রক্ষিত আছে।

আজ বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায় খালেদা জিয়ার আপিল দুটি শুনানির জন্য ২ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।

এতিমদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই ওই মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ রায় দেন। রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আহমেদ পৃথক আপিল করেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল দেন। তিনটি আপিল ও রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট একসঙ্গে রায় দেন। রায়ে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ হয়। দুদকের রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া রুল যথাযথ ঘোষণা করে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হক কামালের আপিল খারিজ করেন হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছর আপিল করেন শরফুদ্দিন আহমেদ, যেটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে।