চৌকি বসিয়ে কেনাবেচা করতে চান ব্যবসায়ীরা

ঈদের আগপর্যন্ত চৌকি বসিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া ও ক্ষতিপূরণের দাবি দক্ষিণ সিটির মেয়রের কাছে তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর বঙ্গবাজারে পোড়া স্তূপ থেকে অবশিষ্ট মালপত্র খুঁজছেন এক ব্যবসায়ী
ছবিঃ প্রথম আলো

পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বেশি বিক্রির আশায় দোকানে বাড়তি পোশাক তুলেছিলেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকানমালিক মো. সাঈদ হোসেন। তিনি দাবি করেন, পোশাক কিনতে বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে ১৫ লাখ টাকা ও বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগার আগের দিন গত সোমবারও তাঁর দোকানে আনা হয়েছিল ছয় থেকে সাত লাখ টাকার মালপত্র। সবই পুড়ে গেছে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সামনে গতকাল বুধবার দাঁড়িয়ে ছিলেন সাঈদ। সেই সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরিবারে স্ত্রী, তিন সন্তানসহ পাঁচ সদস্য। দোকানের আয় দিয়েই পরিবার চলে। দোকান পুড়ে যাওয়ার পর তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তিনি এখন চান, পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের জায়গায় ঈদ পর্যন্ত চৌকি বসিয়ে তাঁদের কেনাবেচা করতে দেওয়া হোক এবং এককালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হোক।

ঢাকার ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুড়ে যাওয়া দোকানমালিকদের দাবিও এ দুটিই। তাঁরা এ দাবি গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে তুলে ধরেছেন। গতকাল বিকেলে নগর ভবনে দোকান মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে মেয়রের বৈঠক হয়। এর আগে বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা মানববন্ধন করেন, যেখানে সহায়তার দাবি জানানো হয়।

মেয়রের সঙ্গে দোকানমালিকদের বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালিক সমিতির নেতারা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের জায়গায় আপাতত চৌকি বসিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ চেয়েছেন। জবাবে মেয়রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের তালিকা তৈরির আগেই চৌকি বিছিয়ে ব্যবসা শুরুর অনুমতি দিলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাই আগে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা দরকার। তালিকা হলে অনুরোধটি বিবেচনা করা হবে।

সূত্র আরও জানায়, বিপণিবিতানের দোকানমালিকেরা মেয়রের কাছে মালামাল চুরি যাওয়ার অভিযোগ করেন। মেয়র বৈঠক চলাকালেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান।

বৈঠকে অংশ নেওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি বিপণিবিতানের একটি আদর্শ মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত জায়গাটি সংরক্ষণ করা, সেখানে পুলিশ মোতায়েন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ঈদের আগপর্যন্ত চৌকি বিছিয়ে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়েছে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে গত মঙ্গলবার আগুন লাগে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েকটি বিপণিবিতানেও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার দোকান পুড়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এদিকে গতকালও দিনভর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স লাগোয়া অ্যানেক্স-কো টাওয়ারে থেমে থেমে ধোঁয়া ও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুন নেভাতে সেখানে দিনভর ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করেছে।

বঙ্গবাজারে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত থেকে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া দোকানের মালিকেরা ছাইয়ের ভেতরে অক্ষত কিছু পাওয়া যায় কি না, তা খোঁজাখুঁজি করছেন। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিকেরা পানিতে ভেজা পোশাক সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সেখানে উৎসুক জনতা, স্থানীয় বাসিন্দা ও ছিন্নমূল লোকজনের ভিড় ছিল। কেউ কেউ দোকানের যা কিছু পাচ্ছিলেন, নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। ব্যবসায়ীরা বিষয়টি নিয়ে একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, আগামী শনিবারের মধ্যেই তারা ক্ষতিগ্রস্তদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও পাশের বিপণিবিতানগুলোতে ৪ হাজার ৬৬১ ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি রয়েছেন বলে তাঁরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় পড়েছে। জায়গাটির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, টিন-কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দোকানের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। করপোরেশন সূত্র জানায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স থেকে তারা বছরে এক কোটি টাকার মতো ভাড়া (সালামি) পেত। ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন থেকে আয় হতো প্রায় ৭৫ লাখ টাকা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। ১০ বার নোটিশও দিয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে নতুন বহুতল ভবন করতে উদ্যোগ নিয়েছিল তারা। তবে দোকানমালিকেরা আদালতে গেলে ভবন নির্মাণের ওপর স্থগিতাদেশ আসে।

সাধারণ দোকানমালিকেরা বলছেন, এসব জানেন দোকান মালিক সমিতির নেতারা। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স আগের অবস্থায় থাকলেই তাঁদের লাভ। কিন্তু যাঁরা অন্যদের কাছ থেকে দোকান কিনেছেন, ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছিলেন, তাঁরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানমালিক বলেন, সাধারণ দোকানমালিক ও কর্মচারীদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। তাঁদের এখন জীবিকার অবলম্বন দরকার।