রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) উৎপাদন প্রস্তুতিসংক্রান্ত সনদ সই করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ায় ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু হচ্ছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এ জ্বালানি দেশে আসার কথা রয়েছে। তা দেশে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় উঠে যাবে বাংলাদেশের নাম।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে রাশিয়া সফরে আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুই দেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে ইউরেনিয়াম উৎপাদন প্রস্তুতি সনদ সই হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। মস্কোর একটি কূটনৈতিক সূত্রও জানিয়েছে, সনদ সই হওয়ায় অক্টোবরের মধ্যেই বাংলাদেশে পারমাণবিক জ্বালানি চলে আসবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় রূপপুরে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। আর রূপপুরের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশনের (রোসাটম) সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিপাত্রে একবার পারমাণবিক জ্বালানি মজুত করা হলে তা দিয়ে এক বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এরপর আবার নতুন করে চুল্লিপাত্রে জ্বালানি মজুত করতে হবে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানির সব ধরনের উপযোগিতা, আন্তর্জাতিক মান বিচার করার পরই পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের প্রস্তুতিসংক্রান্ত চুক্তিটি করা হয়েছে। তবে প্রথম আলোর থেকে যোগাযোগ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার (আইইএ) অনুমোদন এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের রপ্তানি নীতি বজায় রাখতে হবে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এ জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছাবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এরপর একের পর এক মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও আসতে থাকে। রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয় এতে। যন্ত্রপাতি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছর রূপপুরের যন্ত্রপাতি নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা একটি জাহাজ ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ। তিন মাস পর সেই জাহাজ থেকে রূপপুরের যন্ত্রপাতি খালাস হয় অন্য জাহাজের মাধ্যমে। গত ১২ এপ্রিল রাশিয়ার ৮০টি প্রতিষ্ঠান ও এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে রোসাটমের সংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাটির বিদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট ইভজেনি পাকেরমানভের নামও আছে।
তবে রূপপুর কর্তৃপক্ষ ও রোসাটম সূত্র বলছে, করোনা মহামারিতেও রূপপুরের কাজ নিয়মিত চলেছে। পরে যুদ্ধের কোনো প্রভাবও এখানে পড়েনি। লেনদেন কিছুদিন বন্ধ থাকলেও কাজ চালিয়ে গেছে রোসাটম। এখন সেই জটিলতাও কেটে যাচ্ছে। ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়েন ব্যবহারের বিষয়ে সম্মত হয়েছে রাশিয়া ও বাংলাদেশ। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি দেশে চলে এসেছে। জুনের মধ্যে সব পূর্ত কাজ শেষ হয়ে যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই রূপপুর উৎপাদনে আসবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণসহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। আগামী বছর প্রথম ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায় রূপপুর কর্তৃপক্ষ। একই বছর বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার আশা করছে তারা।
এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুরে ইউনিট-১–এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলা যায়। এটি স্থাপনে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার (আইইএ) মান অনুসরণ করতে হয়েছে।