বাঙালি সংস্কৃতির উৎস সন্ধানে
সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো—এর রূপান্তর আছে, মৃত্যু নেই। মানুষের জীবনচর্চা ও চর্যার বৈচিত্র্যময় সমন্বিত রূপই সংস্কৃতি। সামাজিক মানুষের জীবনযাপন-পদ্ধতি, ধারাবাহিক ঐতিহ্য, প্রজন্ম-পরম্পরা আচার-বিশ্বাস-প্রথা, ভূয়োদর্শন, ভাব-ভাবনা, নীতি-নৈতিকতা, উৎপাদন-উদ্ভাবন—এই সবই সংস্কৃতির মৌল উপকরণ।
সংস্কৃতির পরিসর-পরিধি বিশাল ও ব্যাপক। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট ছকে-বাঁধা সংজ্ঞা-সূত্রে একে সীমাবদ্ধ করা চলে না। দেশ-কাল-ভাষা-ধর্মভেদে সংস্কৃতিও ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিও এসব রূপ-বৈশিষ্ট্যের সমবায়ী মৌচাক।
তবে বহুভঙ্গিম বাংলার সংস্কৃতির ধারা একতালে চলেনি, তা রাজনৈতিক-সামাজিক-আর্থনীতিক-শৈক্ষিক-প্রাযুক্তিক—নানা অভিঘাতে ক্ষয়িষ্ণু, খণ্ডিত, রূপান্তরিত, পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। আধুনিক শহুরে জীবন জন্ম দিয়েছে নগর-সংস্কৃতির, মার্জিত-শোভন হলেও এই সংস্কৃতি অর্বাচীন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা এখানে অনুপস্থিত। বাংলার সুদূর অতীতের কৌমসমাজের স্মৃতিনির্ভর সংস্কৃতিই আদিবাসীদের সংস্কৃতি।
বাংলার লোকসংস্কৃতি বঙ্গজনপদবাসীর যৌথ জীবনচর্চার এক আন্তরিক ভাষ্য। সমন্বয়, সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন বাংলার এই লোকসংস্কৃতি।
এই প্রাচীন আদিবাসী সংস্কৃতি বেঁচে আছে তাদের রক্ষণশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে। বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্রে বৈচিত্র্যের প্রতীক হয়ে লোকসংস্কৃতির অবস্থান ও অস্তিত্ব। আবার বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে আদিবাসী সংস্কৃতির রয়েছে প্রচ্ছন্ন আত্মীয়তা। আর নগর-সংস্কৃতি নববর্ষ-মেলা-নবান্ন উৎসবের আয়োজন এবং মরমি লোকগান বা গ্রামীণ যাত্রাকে নগরজীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যার জন্য লোকসংস্কৃতির কাছে গভীরভাবে সে প্রেরণাবদ্ধ ও ঋণী।
প্রকৃতপক্ষে লোকসংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা—এর মর্মমূলেই আবহমান বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতার প্রকৃত পরিচয় প্রোথিত। যথার্থ পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ এখনো এ দেশে হয়নি। গ্রামীণ সমাজ এবং সভ্যতার স্মৃতি ও ছাপ এখনো এই অপরিণত নগরগুলো বহন করে চলেছে। জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতিই সংস্কৃতির নিয়ামক।
মূলত কৃষিজীবন ও নদ-নদী বাংলার সংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামই ছিল বাংলার প্রাণকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির উৎস, লালন ও বিকাশক্ষেত্র। এই গ্রামকেন্দ্রিক সংস্কৃতির মধ্যেই বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয় প্রচ্ছন্ন। এই প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, ‘বস্তুত বাঙালীর ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসঙ্গীতের ও লোকবিশ্বাস-সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম।’ (বাঙলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব; পৃ. ৯)
দুই.
গোপাল হালদার হাজার বছরের চলিষ্ণু বঙ্গ-সংস্কৃতিকে ‘পল্লীপ্রধান বাঙালী সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন (সংস্কৃতির রূপান্তর; পৃ. ২১৭)। আফসোস করে তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘...অত্যন্ত পরিচিত বলিয়াই আমরা তাহার সহজ ও অনাড়ম্বর উপকরণ ও উপাদানকে আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অবলম্বন বলিয়া ভাবিতে কুণ্ঠিত হই।’ (ঐ; পৃ. ২১৭)
বাংলার লোকসংস্কৃতির জগৎ বিচিত্র ও ব্যাপক। লোকসমাজের জীবনাচরণ ও ভূয়োদর্শনের প্রতিফলন আছে লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার আর লোকাচারে। পালা-পার্বণ-বিবাহ-ক্রীড়া-মেলা-নবান্নে মূর্ত হয়ে ওঠে উৎসব-আনন্দের রূপ। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অনুষঙ্গে আসে পোশাক-পরিচ্ছদ-সজ্জা-প্রসাধন–খাদ্যের কথা।
শিল্পকলার মোহন-ভুবনে রচিত হয়েছে প্রয়োজন ও সৌন্দর্যের অনন্ত সখ্য। লোকসাহিত্যে ফুটে উঠেছে জীবনের গভীর উপলব্ধি ও আনন্দের আলেখ্য। এসব উজ্জ্বল উপাদানেই নির্মিত হয়েছে লোকসংস্কৃতির সাতনরি।
বাংলার লোকসংস্কৃতি বঙ্গজনপদবাসীর যৌথ জীবনচর্চার এক আন্তরিক ভাষ্য। সমন্বয়, সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন বাংলার এই লোকসংস্কৃতি। ইতিহাস-পূর্বকালের বঙ্গজনপদের আদিম অধিবাসীদের জীবনযাপনের অনুষঙ্গে বিশ্বাস-সংস্কার ও লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই লোকসংস্কৃতির জন্ম। নৃতাত্ত্বিক বিচারে নানা জনগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণে যেমন বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে, তেমনি তার সংস্কৃতি সম্পর্কেও এ কথা সত্য। সুদূর অতীতের স্মৃতিচিহ্নবাহী বাংলার লোকসংস্কৃতি তাই ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র ধারণাটি সার্থক করে তুলেছে।
বাংলার লোকসংস্কৃতির উপাদান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় আনন্দ-রূপের সন্ধান, প্রবল জীবনাগ্রহ, প্রতিবাদী চেতনা, ধর্ম–নির্বিশেষ মানুষের কথা, মানবিকতা ও ইহজাগতিকতার পরিচয়। লোকায়ত বাংলার উদার মানবিক জমিনের অধিবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠী চিরকালই ভাব-বিদ্রোহী, মিলনপ্রয়াসী, সমন্বয়পন্থী। ‘বিবাদে-বিরোধে বর্বরতা’—এ কথা লৌকিক সমাজের মানুষ তাদের জীবনাচরণে সত্য করে তুলেছে। আমরা বাংলার লোকসংস্কৃতির সাধারণ রূপের প্রেক্ষাপটে তার সমাজসংলগ্ন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই, যার সূত্রে আধুনিককালে লোকসংস্কৃতির গুরুত্ব এবং তার প্রগতিশীল উপকরণ আবিষ্কৃত হয়ে বর্তমান প্রজন্মকে প্রাণিত ও শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে পারে।
তিন.
লোকসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের সঙ্গে সুদূর অতীতের টোটেম, ট্যাবু ও জাদুবিদ্যার সম্পর্ক অতি নিবিড়। সংকট-শঙ্কা-অমঙ্গল দূরীকরণের পন্থা-পদ্ধতির সঙ্গে লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের গভীর যোগ। ব্রত-মানত-বশীকরণ-জাদু-মন্ত্র-ঝাড়ফুঁক-টোটকা-তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে আধি-ব্যাধির নিরাময়, ইচ্ছাপূরণ ও মুশকিল আসানের চেষ্টা চলে। এ ক্ষেত্রে যে আচার-পদ্ধতি, তা অনেকাংশেই কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি বা শাস্ত্রাচার অনুসরণ করে না। লোকবিশ্বাস ও সংস্কারে ধর্মের শাসন-গণ্ডি হামেশাই অতিক্রান্ত হয়ে যায়।
গার্সি বা ওলাবিবি-ভিটেকুমোরের পূজা, পীর-দরবেশের দরগায় মানত—এসব ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের জাত-পরিচয়ের ভেদাভেদ লুপ্ত। মুসলমান কৃষকের মনসা-তুষ্টির পূজা কিংবা হিন্দু মাঝির ‘বদর বদর’ বলে দরিয়ায় যাত্রা শুরু—এই সবই লোকসংস্কারের অন্তর্গত, যা প্রজন্ম-পরম্পরায় প্রচলিত। বৃষ্টি কামনায় যেমন কোনো পল্লিবাসী কৃষিনির্ভর হিন্দু ‘আল্লাহ্ ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে-রে তুই’ গান গাইতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, তেমনি হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিয়ে সাপের মন্ত্র-উচ্চারণে মুসলমান ওঝার কোনো দ্বিধা থাকে না। আসরবন্দনায় ভক্তি-নিবেদনে আল্লাহ-ভগবান, রসুল-দেবতা সম-পাঙ্ক্তেয়, একই নিশ্বাসে উচ্চারিত।
বাংলার লোকাচারেও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে অভিন্নতার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু, কৃষিকর্ম—এই সব বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত লোকাচার বাঙালির জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বন্ধ্যা নারীর সন্তান কামনা, গর্ভবতী রমণীর ‘সাধভক্ষণ’, সন্তান জন্মের পর অনিষ্ট-ভঞ্জন-সতর্কতা ও বিবাহের কিছু আচার লোকসমাজে অভিন্ন। কৃষি-সম্পর্কিত লোকাচারেও সাদৃশ্য আছে। বৃষ্টি কামনা, বীজ বপন, ফসল রক্ষা, ফসল তোলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে লোকাচার পালিত হয়, তাতে কৃষিজীবী–সমাজের সমমানসিকতা ও চেতনাগত ঐক্য-একাত্মতার আন্তরিক চিত্র ফুটে ওঠে।
বাংলার লোকজীবনে আবাস-আসবাব—খাদ্য-পরিধেয়-প্রসাধন-অলংকার-তৈজসপত্রও মূলত এক। খড় বা শণের আবার স্থানবিশেষে টালি বা ঢেউটিনের দোচালা ঘর, পাটকাঠি বা কঞ্চির বেড়া, একপাশে গোয়ালঘর, একচিলতে উঠোন, চারপাশে গাছগাছালি—গ্রামীণ মানুষের বাস্তুগৃহের এই হলো সাধারণ ছবি। মাদুর-কাঁথা, বাঁশের মাচা কিংবা মাটির মেঝে শয়নের উপকরণ।
ব্যবহারের তৈজসপত্রের মধ্যে মাটির হাঁড়ি-পাতিল-সানকি-কুঁজো, কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি-ঘটি-ঘড়া; এসবই প্রধান। কেবল নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শাস্ত্রনিষিদ্ধ ভক্ষদ্রব্য বাদে বাঙালি সমাজের খাদ্যাভ্যাসও প্রায় অভিন্ন। লোকায়ত বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল এক—ধুতি, লুঙ্গি, চাদর, গামছা, ফতুয়া ইত্যাদি। আর মোটা সুতার তাঁতের শাড়ি গ্রাম্য রমণীর সর্বজনীন আটপৌরে পোশাক। কোনো কোনো অঞ্চলে বিবাহিত মুসলিম রমণীদের মধ্যে শাঁখা-সিঁদুর ব্যবহারের চলও আছে।
প্রমোদ-বিনোদন-ক্রীড়ার ক্ষেত্রেও সম্মিলিত অংশগ্রহণের বাতাবরণ যেমন অনুকূল, তেমনি সুযোগও ছিল অবারিত। নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হাডুডু—এসব লৌকিক ক্রীড়ার রূপ ছিল সর্বজনীন। মেলা কিংবা নবান্নের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বাংলার প্রায় সব লৌকিক মেলাই ধর্মাশ্রিত, তা সাধু-গুরুর জন্ম-মৃত্যু, পূজা-পার্বণ, রথ-স্নানযাত্রা কিংবা ঈদ-মহররমকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। উপলক্ষ ধর্মীয় উৎসব হলেও মেলার মেজাজ-চেহারা কিন্তু পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় তা লালিত।
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমবায়ের আনুকূল্যে বাংলায় এক সমৃদ্ধ লোকশিল্পকলার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। মূলত জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজন ও চাহিদাই ছিল এই শিল্পকলার প্রেরণা এবং তা সিদ্ধ করেও এর মধ্যে শিল্পবোধ আর সৌন্দর্যচেতনার স্বাক্ষর প্রতিফলিত হয়েছে। নকশা-আলপনা, লোকচিত্র, মৃৎ-ধাতু-বাঁশ-বেত-কাঠ-সুচি-বয়ন বা বাস্তুশিল্প লোকশিল্পকলার এই যে বিশাল জগৎ, এতে বাংলার লোকশিল্পীদের মেধা, নৈপুণ্য, উদ্ভাবনা ও শিল্পবোধের পরিচয় বিধৃত।
লোকবিজ্ঞানী এই লোকশিল্পের মধ্যেও যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ অভিন্ন শিল্পচেতনার পরিচয় খুঁজে পান, তা তাৎপর্যপূর্ণ, ‘এই শিল্পকলার মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতা নেই। হিন্দু বাঙালী তার লক্ষ্মীর পা, ঝাঁপি কিংবা সরায় যে বক্তব্য রাখেন, বাঙালী মুসলমান জায়নামাজ ও মহরমের বিচিত্র মটিফসম্পন্ন পিঠেতেও সেই একই বক্তব্য রাখেন। উদ্দেশ্যও একই। ধর্মের মধ্যে যা মহৎ তাকে উৎসাহিত করা।’ (বাংলাদেশের লৌকিক ঐতিহ্য, আবদুল হাফিজ; পৃ. ১৮) এই অভিন্ন শিল্পচেতনা বাঙালির জাতিগত ঐক্যকে সংহত করেছে।
বাঙালি সমাজ এক ঐতিহ্যপূর্ণ সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী। ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-মন্ত্র-কিংবদন্তি লোকশ্রুতি-লোককথা- লোককাহিনি-গীতিকা ও গীতির এক বিপুল ঐশ্বর্যভান্ডার নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার লোকসাহিত্য। লোকসংস্কৃতির অবকাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এই লোকসাহিত্য। বাঙালি-মানসের, তার শিল্পচিত্তের গভীর পরিচয় এখানে মিশে আছে।
লোকসাহিত্যের অন্তর্গত শিল্পনিদর্শনের মধ্যে লোক-সাধনাশ্রয়ী সম্প্রদায়-গীতি ছাড়া আর সবই সমাজের সমষ্টিগত সৃষ্টি, যা কাল থেকে কালান্তরে প্রসারিত, প্রজন্ম-পরম্পরায় যা লালিত হয়ে আসছে। এসব রচনায় সমাজ-অভিজ্ঞতার স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কখনো কখনো ইতিহাসের টুকরো ছবিও দুর্লক্ষ্য নয়। অজ্ঞাতনামা লোককবিদের রচিত গানে পলাশীর যুদ্ধের স্মৃতি, নীল বিদ্রোহের কথা, গণ-আন্দোলনের চিত্র অম্লান হয়ে আছে। টিপু পাগলার বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রেরণায় লোককবির কাছে ধরা দেয়।
সামন্ত সমাজের নির্মম শোষণ, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অবিচার, শাস্ত্রাচারশাসিত ধর্মের হৃদয়হীন প্রভুত্ব সমাজে ভাববিদ্রোহী বাউলের জন্ম দিয়েছে। শাস্ত্রদ্রোহী ও জীবনজিজ্ঞাসু বাউলসমাজ সামাজিক অনৈক্য ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
এই দর্শন-দারিদ্র্যের দেশে বাউলসমাজই অধ্যাত্মসাধনার মোড়কে একটি জীবনবাদী দার্শনিক তত্ত্ব উপহার দিয়েছে। বাউলগান ও সমানধর্মা মরমিসংগীতে তত্ত্ব ছাপিয়ে মানববন্দনা, মর্ত্যপ্রীতি, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি ও মানবিকতাবোধের অন্তরঙ্গ প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
বাউলমতের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ফকির লালন সাঁইয়ের গানে জাত–ধর্মের বিভক্তি, ছুঁতমার্গ-অস্পৃশ্যতা নিন্দিত হয়েছে। বর্ণভেদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। ধর্মীয় জাতিত্বে অবিশ্বাসী লালন তাই জাত হাতে পেলে আগুন দিয়ে পোড়ানোর অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন।
মানবতার আদর্শে অনুপ্রাণিত লালন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও শ্রেণি-শোষণের অবসান কামনা করে জাতপাতহীন এক সুসম মানবসমাজ গঠনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। মানবজন্মের সুকৃতি, মানবের শ্রেষ্ঠত্ব ও ইহজাগতিকতার উচ্চারণও শুনি লালনের গানে, ‘এমন মানব-জনম আর কি হবে।/ মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।/ অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই/ দেব-দেবতাগণ/ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে।।’
শুধু তা–ই নয়, লালন ফকির, লোকসমাজের এই মহত্তম সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি, জমিদারের পীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একতারা ফেলে লাঠি হাতে রুখে দাঁড়াতেও পিছপা হননি। লালনের শিষ্য দুদ্দু শাহও ছিলেন সামাজিক অঙ্গীকারে দৃঢ়-দৃপ্ত মুক্তমনের সাধক-বাউল। প্রতিবাদী মরমি সাধকের তালিকায় আরও উল্লেখ করতে হয় জালাল খাঁ, রমেশ শীল, বিজয় সরকার, মহিন শাহ, শাহ আবদুল করিম এবং আরও কারও কারও নাম। দূর-অতীতের কৃষিসমাজের স্মৃতিবাহী মরমি সম্প্রদায়ের বাউলগান বাংলার লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অধ্যায় ও অনন্য সাংস্কৃতিক সম্পদ।
চার.
বাংলার লোকসংস্কৃতিতে সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের যে রূপ প্রতিফলিত, তার আভাস আমরা দিয়েছি। এই লোকসংস্কৃতির মূলধারাটি প্রবল জীবনাগ্রহ ও মানবিক চেতনাবোধের ভেতর দিয়ে ইহজাগতিকতায় সমর্পিত। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনের সংকট-সমস্যায়ও লোকসংস্কৃতির জনক-ধারকেরা সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। ছড়া-গীতি-গীতিকায় আছে সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার স্বাক্ষর। প্রকৃতপক্ষে জীবনঘনিষ্ঠতা ও সমাজসংলগ্নতা বাংলার লোকসংস্কৃতিতে একটি জীবনবাদী ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে।
এই লোকসংস্কৃতিচর্চার ভেতর দিয়েই একদিন বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও স্বরূপ-অন্বেষার সূচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ঋত্বিক। গুরুসদয় দত্ত এই লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ব্রতচারী আন্দোলন। এই ধারায় আরও নাম করতে হয় দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্রকুমার দে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদসহ অনেকের। পরে এসে যোগ দেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, আশুতোষ ভট্টাচার্য—এঁরা। বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য লোকসংস্কৃতিই ছিল অন্যতম অবলম্বন।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি যুগের গানের কথা বলতে হয়। বাউলের সুর বসিয়ে রচনা করা তাঁর সেসব স্বদেশি গান, কী অবিস্মরণীয় উদ্দীপনা জাগিয়েছিল বাঙালির মনে, তা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, যে গানটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, সেই গানের জন্যও রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহের গগন হরকরার বাউলগানের কাছে যেতে হয়েছিল।
চারণকবি মুকুন্দদাসের স্বদেশি যাত্রা ও গান বাঙালিকে মুক্তিপাগল করেছিল। আমাদের দেশের নানা সংগ্রাম-আন্দোলনেও লৌকিক সমাজের কবি ও গায়কদের বিশেষ ভূমিকা আছে। ভাষা আন্দোলনের গান বেঁধে এক বাউল কবি মহিন শাহ পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাও লোককবিদের রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে।
লোকসংস্কৃতি বাঙালি-জীবনের এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণার নিদর্শন। তবু কোনো কোনো নগর-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সভ্যতাগর্বী শিক্ষাভিমানী পণ্ডিত অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর উন্নাসিকতায় লোকসংস্কৃতিকে খারিজ করতে চান। এই বিরূপ মনোভাবের বিপক্ষে এখানে একজন লোকবিজ্ঞানীর মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্ববহ, ‘বাংলার সংস্কৃতি বাংলার পল্লীতেই জন্ম ও পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছে; সেইজন্য আজ যে নাগরিক সংস্কৃতি এ’দেশের উপর উহার স্পর্দ্ধিত শির উন্নত করিয়া দাঁড়াইতে চাহিতেছে, তাহা কিছুতেই জাতির মর্মমূলে নিজের শিকড় প্রবেশ করাইতে পারিতেছে না; উপরের দিক হইতে ইহাকে যতই শক্তিশালী বলিয়া মনে হইতেছে; ভিতরের দিক হইতে তাহা ততই শক্তিহীন হইয়া পড়িতেছে।
অতএব কল্যাণের পথে সমাজকে যাহারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন, ধ্বংসোন্মুখ পল্লীজীবনের মধ্যেই এখনও তাঁহাদিগকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানের সন্ধান করিতে হইবে।’ (‘বাংলার লোকশ্রুতি’, আশুতোষ ভট্টাচার্য)। এই বোধ ও বোধি বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার বিশুদ্ধ সূত্র হিসেবে গৃহীত হতে পারে।
জাতির ক্রান্তিলগ্নে কিংবা জাগৃতি-মুহূর্তে তার ঐতিহ্যলগ্ন আত্মপরিচয় সম্পর্কে কৌতূহল ও সন্ধিৎসা জাগে, যেমন জেগেছিল ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কালে। গ্রাম এবং তার সংস্কৃতিই আমাদের যথার্থ পরিচয়ের ঠিকুজি।
বিশাল বাংলার যে গ্রামকে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা আমাদের স্মৃতি-স্বপ্ন, গৌরব, ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাস—তাকে আবিষ্কারের মাধ্যমেই আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ উন্মোচিত হবে। সে-ই হবে বিস্মৃত–বিভ্রান্ত বাঙালির সত্যিকারের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’।