প্রতিরোধের মার্চ—৩
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাস্তবায়ন জরুরি
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।
একাত্তরে দেশের সাহসী সন্তানেরা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা লাভের এক দুর্নিবার চেতনা অন্তরে ধারণ করে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, দেশের উন্নয়ন ও জনগণের ভাগ্যবদলের এক নতুন সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে আমরা একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পেরেছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। কিছু কিছু ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি। আবার কিছু মানুষের মুখে শুনেছি। স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের সমান অধিকার ছিল না। দারিদ্র্যের ব্যাপকতা ছিল মারাত্মক। বহু মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাত। বাবা বলতেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে ওদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না।’
আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী অজিত কুমার চক্রবর্ত্তী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। এলাকায় তিনি গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মানুষ গভীর রাতে ডাকলেও তিনি চিকিৎসা দিতে ছুটে যেতেন। গরিব মানুষ চিকিৎসার জন্য এলে তিনি বলতেন, ‘আমাকে টাকা দিতে হবে না, এই টাকা দিয়ে পথ্য নিয়ে যাও।’
বাবা গ্রামের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে একত্রে গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা স্বপ্নের কথা বলতেন। একাত্তরের নভেম্বরে কোনো একটা খবর শুনে বাবা একদিন উত্তেজিত হয়ে এসে মাকে বলেছিলেন, ‘মানুষ জেগে উঠেছে। পাকিস্তানি সেনাদের হারিয়ে দিচ্ছে। আর বেশি দেরি নেই। দেখো, দেশ স্বাধীন হবেই।’ বাবা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্রের নির্মম আঘাতে তাঁর জীবন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
রাজাকার-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের খুব কুখ্যাতি ছিল। পাকিস্তানি হানাদারদের মদদপুষ্ট হয়ে রাজাকাররা একাত্তরের ২৮ নভেম্বর গভীর রাতে বাবাকে চোখ ও হাত বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি, আরিচা ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশে বাবাকে হাত-পা বেঁধে যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
তবু বহু কষ্টে সাঁতরে তিনি আরিচা ঘাটের কাছে নদীর তীরে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু সে খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা এসে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, সহযোগিতা করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার কারণে বাবা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের রোষানলে পড়েন। তারা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
সেই স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হলো। কিন্তু যেসব মূল্যবোধ ও আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, এত দিনেও তা আমরা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। জাতি হিসেবে এটা কি আমাদের ব্যর্থতা নয়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের জাতীয় সংহতি এবং নৈতিকতা সুদৃঢ় করতে পেরেছে কি? দুর্নীতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। জাতীয় উন্নয়নে আমরা একতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। একটি দুর্নীতিমুক্ত ও শোষণহীন সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে আর কতটা সময়ের প্রয়োজন?
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সেই দেশপ্রেমের চেতনা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে আদর্শ, লক্ষ্য, দেশপ্রেম, সাহস ও একতা নিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছিলেন, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আরও দৃঢ় করতে হলে সেগুলোকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তৃণমূল থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা ও দেশপ্রেমের মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শহীদের সন্তানদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটতে পারে।
অজয় কুমার চক্রবর্ত্তী: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী অজিত কুমার চক্রবর্ত্তীর বড় ছেলে