রাষ্ট্র-প্রশাসন-সমাজে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব বেড়েছে

‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই সভার আয়োজন করে সংগঠনটি। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৭মে
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার দেড় দশক ধরে একটানা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব বেড়েছে। ব্যতিক্রম বাদে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় দুষ্ট হয়ে পড়েছেন। এ রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অস্তিত্বসংকটে পড়েছে।

‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব কথা উঠে এসেছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সভার আয়োজন করে সংগঠনটি।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারের ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তিনি ১৯৭১ সালের চেয়ে এখন দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খারাপ বলে মনে করেন। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এখনো অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সম্মুখভাগে রয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা থাকলেও অসাম্প্রদায়িক দেশের দাবি কার্যকর করতে হলে সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন কার্যকর করতে এবং দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়নে সরকার কাজ করছে বলে জানান ভূমিমন্ত্রী।

সভায় দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্ষয়িঞ্চু হতে হতে ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে বলে উল্লেখ করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার। সংখ্যালঘু কমার পেছনে দুটি কারণকে দায়ী করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে যে কিছু অবস্থা সৃষ্টি করা হয়নি, তা নয়। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটে, সেসবের বিচার প্রকৃতপক্ষে হয় না। আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনোবৃত্তি অনেকাংশে দায়ী। সংখ্যালঘু মানুষদের মানসিকভাবে সবল ও সংগ্রামী মনোভাব থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনতিভবিষ্যতে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। দূরবর্তী ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না।’

তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শক্তি তাদের ভোট বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, যদি ৯ শতাংশ মানুষের ভোট একত্র করা যায়, তাহলে অনেক বড় জাতীয় দাবি এর পক্ষে আনার সুযোগ আছে। তবে এটাও পারা গেল না উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভোট নিয়ে যে তুষ্টি থাকা দরকার, তা বোধ হয় যাঁরা সরকারে এসেছেন, তাঁদের ভেতরে নাই। যাঁরা সরকারে নাই, তাঁদের ভেতরেও নাই। আর আমার মতো ভোটারের তো নাই–ই। কারণ হলো, ভোটকে কেন্দ্র করে ক্ষমতায় যে যেতে চায়, তাহলে এই ১০ শতাংশের মন জয় করতে হবে ভোট পাওয়ার জন্য এবং তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ তো আমরা পেলাম না।’

সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন রূপ দেখা যাচ্ছে। যেমন রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা, প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতা। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতার কারণে অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে সংখ্যালঘুরা শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। অমর্যাদাকর শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে অবমাননা করা হচ্ছে। ভয়ভীতি ও হুমকি অব্যাহতভাবে চলছে। সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ধ্বংস করা হচ্ছে, আগুন দেওয়া হচ্ছে। জায়গা–জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মেয়েদের অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। সরকার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি, যা হতাশার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমাদের জীবদ্দশায় বোধ হয় সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আর দেখতে পারব না। শিশুকাল থেকে যেভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, সেখান থেকেই একটা ধর্মীয় বিভাজন তৈরি হচ্ছে। এই সরকারের আমলেই পাঠ্যসূচিতে সাম্প্রদায়িক কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। পাঠ্যসূচির মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেসব বাস্তবায়নে সামাজিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে বলেও মনে করেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক মানুষ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। যাঁরা সরকারে আছেন, শুধু রাজনীতিবিদ নয়, যাঁরা প্রশাসনে আছেন, তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে। এটাই খুব ভয়ের ব্যাপার। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য সহনশীলতানীতি’ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, আজকাল সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতা আছে বলে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসন কঠোর থাকলে সেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয় না।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিম চন্দ্র ভৌমিক ও অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।