সুরে, ছন্দে, বাণীতে তিন দিন ধরে ভাসলেন শ্রোতারা। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে গতকাল শনিবার রাতে শেষ হলো ৪১তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন। এবারের আয়োজনের শুরু আর শেষ দিনের বোধন সংগীতেও ছিল যেন সেই সুর। দুই দিনই শিল্পীরা গাইলেন, ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে/ এসো গন্ধে বরণে, এসো গানে।’
আলোচকেরা বললেন, ভালোবাসা, প্রেম, বিরহ, একাকিত্ব, এমনকি বিশ্ব-সংকটেও বাঙালির হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফিরে এসেছেন নব নব রূপে।
গতকাল বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আলোচনা, গুণীজন সম্মাননা, গান, আবৃত্তি আর নৃত্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিপুল এই আয়োজন। তিন দিনের এই সম্মেলনে রাজধানীসহ সারা দেশের পাঁচ শতাধিক শিল্পী ও সংগঠক পরিবেশন করেন শতাধিক উপস্থাপনা। এ বছর রবীন্দ্রপদকে সম্মানিত করা হয় প্রবীণ অভিনয়শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম এবং সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক আ ব ম নুরুল আনোয়ারকে।
গতকাল শেষ দিনের আয়োজন শুরু হয়েছিল সকালে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহান ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে ফুলের ডালি অর্পণ করে। এরপর শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয় প্রতিনিধি সম্মেলন। বিকেলে এর সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক অনুপম সেন। তিনি বলেন, সংকটকালেও সৃষ্টির কত ক্ষেত্রে যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে জড়িয়েছিলেন, সে-ও এক বিস্ময়। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে জয় করেছেন বিশ্বলোক।
আয়োজনের এক পর্যায়ে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য থেকে নাট্যশিল্পী মাসুম আজিজসহ সদ্য প্রয়াত বিশিষ্টজনদের স্মরণ করা হয় নীরবতার মধ্য দিয়ে।
এরপর সম্মেলনের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী লাইসা আহমেদ লিসা। ধন্যবাদ জানান শিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের নির্বাহী সভাপতি আতিউর রহমান বলেন, রবীন্দ্রনাথ-কল্পিত শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চাই পারে মানুষের মধ্যে শুভচেতনার শক্তি সঞ্চার করতে। প্রদীপ প্রজ্বালন করতে অনুপম সেনের সঙ্গে এরপর মঞ্চে ওঠেন সাংস্কৃতিক সংগঠক ডা. সারওয়ার আলী।
পরের পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কখনো একা, কখনোবা সমবেতভাবে একে একে মঞ্চে আসেন শিল্পীরা। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে আবিষ্ট করে রাখেন দর্শক-শ্রোতাদের।
৪ মে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদীপ প্রজ্বালন করে শিল্পী ও সংগঠক সন্জীদা খাতুনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি তাঁর বক্তব্যে স্মরণ করেন সংগীত সংগঠক ওয়াহিদুল হককে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সঙ্গে বাঙালির চেতনা কতটা জড়িয়ে আছে, সে কথা বিশদ করে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দর্শন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে। তার রূপ ধরা দিয়েছিল মঞ্চে আন অমৃতবাণী গীতি-আলেখ্য পরিবেশনায়।
৫ মে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় পাশাপাশি পরিবেশন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের গান। সংগীত পরিবেশন করেন ইফফাত আরা দেওয়ান, প্রিয়াঙ্কা গোপসহ বিভিন্ন প্রজন্মের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার লেখা ‘নদীতীরের প্রেমের গান’ নামে একটি প্রবন্ধ পড়ে শোনানো হয়। এদিন আয়োজনে প্রদীপ প্রজ্বালন করেন সংসদ সদস্য ও অভিনয়শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর। এরপর লাইসা আহমেদ লিসার সংগীত পরিচালনায় সবার উপরে মানুষ সত্য শিরোনামে একটি গীতি-আলেখ্য পরিবেশন করা হয়।
গতকালের আলোচনায় বক্তারা ব্যাখ্যা করেন বাঙালির জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতার কথা। তাই প্রেম থেকে সংকটে বাঙালিকে বারবার ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে। শেষ পরিবেশনা ছিল তামান্না রহমানের পরিচালনায় ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতার নৃত্যরূপ। জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তিন দিনের ৪১তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন।
উৎসব শেষে দেশের নানা প্রান্তে ফিরে গেলেন শিল্পীরা, তাঁদের সবার হৃদয়ে তখন সজীব হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।