বর্ষসেরা বই পুরস্কারের আনন্দ আয়োজন
গতকাল ছুটির দিনে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে দেশের অগ্রগণ্য ও প্রতিশ্রুতিশীল নবীন লেখক, প্রকাশক এবং গ্রন্থানুরাগীদের সমাগমে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল শীতের সন্ধ্যা। উপলক্ষ ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২১’-এর পুরস্কার বিতরণী।
আগেই জানানো হয়েছিল, এবার সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার পেয়েছে প্রকাশনা সংস্থা সংহতি থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গবেষণা গ্রন্থ জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি: ১৯০৫-৪৭। সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার পেয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ইমতিয়ার শামীমের গল্পগ্রন্থ শীতের জ্যোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানে তাঁদের হাতে ক্রেস্ট, প্রত্যেককে এক লাখ টাকার চেক ও অভিজ্ঞানপত্র তুলে দেওয়া হয়। পরিয়ে দেওয়া হয় উত্তরীয়।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের শুভেচ্ছা সম্ভাষণ দিয়ে। তিনি জানান, দ্বাদশবারের মতো প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের ভেতরে প্রকাশিত সৃজনশীল ও মননশীল বইয়ে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য। বিচারকাজের জন্য দেশের গুণী সাহিত্যিক, সাহিত্য সম্পর্কে বু্যৎপত্তিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করা হয়। তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ক্ষেত্রে প্রথম আলো কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এবারে বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন কবি ও কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক। সদস্যরা হলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফকরুল আলম, ওয়াসি আহমেদ ও সোনিয়া নিশাত আমিন। দেশে না থাকায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে ছিলেন না।
আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর গান দিয়েই শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠানের মূল কার্যক্রম। সঙ্গীদের নিয়ে শিল্পী শফি মণ্ডল গেয়ে শোনালেন ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে ময়ূরপঙ্খী নাও’ এবং ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ গান দুটি।
গানের পরে বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনায় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের অভিনন্দন এবং আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে লেখকদের নিজেদের অর্থ খরচ করে বই ছাপতে হয়েছে। এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এমন আলোকময় অনুষ্ঠানে লেখকদের সম্মানিত করা হচ্ছে, বিপুল পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে—এটা আশাব্যঞ্জক ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই বিষয়টি তাঁকে গভীরভাবে আপ্লুত করে। বিচারকাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে মহাকালই হলো সাহিত্যের বিচারক। কী থাকবে, আর কী থাকবে না—তা একমাত্র বলতে পারে মহাকাল। তবু সমসাময়িক কালের একটি সাক্ষ্য থাকা দরকার। সে কারণেই এমন বিচার গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিচারকেরা একমত হয়ে এই বই দুটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এরপর পুরস্কার বিতরণের পালা। প্রথমেই সৃজনশীল শাখায়। অভিজ্ঞানপত্র পড়েন ওয়াসি আহমেদ। ফকরুল আলম ইমতিয়ার শামীমকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেন সৈয়দ শামসুল হক।
প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে ইমতিয়ার শামীম দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, তিনি একই সঙ্গে ভীত ও আশাবাদী। একদিকে মুক্তচিন্তার প্রতি আঘাত আসছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে হামলা হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের চিন্তা রোধ করার জন্য নতুন নতুন বিধিমালা করা হচ্ছে। তবু জীবনের প্রতি ভালোবাসা থেকে সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। হয়তো স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না, তবু গভীর ইঙ্গিতময়তার ভেতর দিয়ে প্রকৃত বিষয়কে তুলে আনার চেষ্টা চলছে। এটাই আশাবাদী হওয়ার বিষয়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অভিজ্ঞানপত্র পড়েন সোনিয়া নিশাত আমিন। লেখককে উত্তরীয় পরিয়ে দেন ফকরুল আলম। ক্রেস্ট ও চেক তুলে দেন সৈয়দ শামসুল হক।
প্রতিক্রিয়ায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বইটি ১০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তাঁর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে কিছু সংক্ষিপ্ত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘১৯০৫ থেকে ৪৭ পর্যন্ত সময়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই আমাদের সমষ্টিগত ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছিল। একটি প্রহসনের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ইংরেজরা ক্ষমতায় এসেছিল আবার তারা যখন চলে গেল তখন পেছনে রেখে গেল দাঙ্গা। ১৯০৫ সালে তারা যা করতে চেয়েছিল, তা চূড়ান্তভাবে করল ১৯৪৭ সালে। বাংলা ভাগ হলো। এমন করে সে ভাগ হলো যে কারও কারও বসতবাড়ির রান্নাঘর পড়ল এক দেশে তো শোবার ঘর পড়ল অন্য দেশে। জাতীয়তাবাদী চেতনার ভেতরে অনুপ্রবেশ করল সাম্প্রদায়িকতা। এসব তথ্য নতুন কিছু নয়। তথ্য বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গিটা নতুন। আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি।’ তিনি বলেন, এরপরে ১৯৭১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও একটি গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে।
পুরস্কার প্রসঙ্গে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পরে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হলেও বইয়ের সরবরাহ ও চাহিদার ক্ষেত্রে খুব উন্নতি হয়েছে, তা বলা যায় না। বইয়ের বিপণন ও পাঠকে আগ্রহী করে তুলতে তিনি গণমাধ্যমের শক্তিকে আরও বেশি করে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। বই প্রকাশ, বিপণন ও পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে লেখকদের উৎসাহিত করায় তিনি প্রথম আলোর ভূমিকার প্রশংসা করেন। পুরস্কৃত অপর লেখক ইমতিয়ার শামীমকে অভিনন্দন জানান।
এরপর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সমাপনী ভাষ্য। তিনি প্রথম আলোর এই আয়োজনের সঙ্গে শুরু থেকে যাঁরা যুক্ত ছিলেন কিন্তু এখন নেই, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবদুশ শাকুর, আবদুল মান্নান সৈয়দকে স্মরণ করেন। এ ছাড়া প্রথম আলোর সব কাজের সঙ্গী শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শুভানুধ্যায়ী মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকেও স্মরণ করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি জানান, বই নিয়ে প্রথম আলোর আয়োজন অব্যাহত থাকবে। সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন থেকে গত বছর ঢাকাসহ সারা দেশে ৩৭টি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী বছর ১০০টি মেলা হবে। এ ছাড়া আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবার্ষিকীতে সিলেটে প্রথম আলোর সহযোগিতায় দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। সেই অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে আমন্ত্রণ জানান।