সড়ক দুর্ঘটনার ৫৯% মামলা মাটিচাপা
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কাওলা পদচারী-সেতুর পাশের বাসস্ট্যান্ডে গত ১৪ জুন রাতে ৬০ বছর বয়সী আবদুস সাত্তার গাড়িচাপায় নিহত হন। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। সাড়ে তিন মাস তদন্তের পর এই মামলা প্রমাণের জন্য পুলিশ কিছুই পায়নি।
পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা, উপপরিদর্শক এস এম মামুনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু গাড়ির চালককে চিহ্নিত করতে পারিনি। এ জন্য আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’
শুধু এই দুর্ঘটনা নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সড়ক দুর্ঘটনার মামলা হয়, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চালক ও যানবাহনকে চিহ্নিত করতে পারে না পুলিশ।
ঢাকা মহানগর আদালত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে ঢাকা মহানগরে গাড়িচাপায় নিহতের ঘটনায় ৯৩৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৩টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়া মামলার মধ্যে ৩৯৯টি মামলায় পুলিশ কোনো আসামি শনাক্ত করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। মাত্র ২৭৪টি মামলার আসামি চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। ২৬৬টি মামলা এখনো তদন্তাধীন। মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৫৯ শতাংশ মামলায় আসামি শনাক্তই করতে পারেনি পুলিশ।
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আদালত যদি বিচারকি মনোভাব নিয়ে এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে আবার পুনরায় তদন্তে পাঠান, তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। সে ব্যাপারে বিচারকদেরও আন্তরিক হওয়া উচিত।
তদন্তের এই হাল নিয়ে অসন্তুষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যেসব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর তালিকা পেলে আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরও অসৎ উদ্দেশে্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে, তাহলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, গাড়ি দুর্ঘটনার মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন কিংবা অভিযোগপত্রে দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির মতামত নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তাঁর কোনো মতামত চাওয়া হয়নি। কেন চাওয়া হয়নি, তা তিনি বলতে পারবেন না।
পুলিশের একজন উপকমিশনার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রেই পুলিশ কৌঁসুলিদের মতামত নেয়। দুর্ঘটনার মতো সাধারণ মামলায় মতামত নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর মতো ঘটনাকে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না বলে স্বীকার করেন তিনি।
যে ৩৯৯টি মামলায় পুলিশ কোনো আসামি শনাক্ত করতে পারেনি, সেগুলোর ৩০টির নথি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, মামলা করার তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, গাড়ির নম্বর ও চালককে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।
আদালতের নিবন্ধন খাতা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে ঢাকা মহানগরের যাত্রাবাড়ী ও বিমানবন্দর থানায় সর্বাধিক দুর্ঘটনার মামলা রেকর্ড হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে হয়েছে ৯৭টি ও ঢাকা বিমানবন্দরে ৮৫টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর থানা-পুলিশ তদন্ত শেষে ৫৪টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও ২৭টি মামলায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ মামলা মাটিচাপা পড়ছে, এমন তথ্য জানানো হলে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘এটা ভাবতেও কষ্ট হয় যে বেশির ভাগ মামলার আসামি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তদন্ত সংস্থা। ঘটনার শিকার পরিবারের লোকজন যদি বিচার পেত, তাহলে কিন্তু এত দুর্ঘটনা ঘটত না। আমরা তাহলে কোথায় আছি?’