সমন্বিত পরিকল্পনা আর নিপুণ স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে হাজার বছর আগেই বাংলাদেশে নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল। একালের আধুনিক নগরের বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্যই এতে ছিল। বিক্রমপুর অঞ্চলে চলমান গবেষণায় মাটির নিচ থেকে বৌদ্ধ সভ্যতার যেসব ধ্বংসাবশেষ এ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে, তার ভিত্তিতে গবেষকেরা এ ধারণা করছেন।
বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক ও পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান প্রাচীন বিক্রমপুরে (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলা) প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ধীরে ধীরে সেই পরিকল্পিত নগরেরই ছবি ফুটে উঠছে। মাটি খুঁড়ে পাওয়া বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, ইটের তৈরি প্রায় অক্ষত দুটি পাকা রাস্তা, বর্গাকার ও আট কোনা স্তূপ (বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচারের বিশেষ স্থান বা সমাধি) আর আঁকাবাঁকা চওড়া দেয়াল এমনভাবে পরিকল্পিত অবস্থানে পাওয়া গেছে, যা একটি পরিকল্পিত নগরের চেহারাই ফুটিয়ে তুলছে।
মুন্সিগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় পাঁচ বছর ধরে এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য অন্বেষণ। গতকাল সোমবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চলতি বছরের গবেষণায় পাওয়া এসব তথ্য জানান অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও প্রকল্প পরিচালক নূহ-উল-আলম লেনিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ গবেষণায় এ বছর যুক্ত হয়েছে চীনের সাংস্কৃতিক স্মারক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ইউনান প্রাদেশিক ইনস্টিটিউট। জাহাঙ্গীরনগর ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
এর আগের বছরগুলোতে এ অঞ্চলে প্রাক্-মধ্যযুগীয় বৌদ্ধবিহার, পঞ্চস্তূপ, আটকোনা স্তূপ ও ইটনির্মিত নালার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এসব স্থাপত্যের সঙ্গে এবার ইটনির্মিত রাস্তা, স্তূপ কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রবেশপথ এবং একাধিক বসতির নিদর্শন পাওয়ায় গবেষকেরা মনে করছেন, এ অঞ্চলে একটি দীর্ঘস্থায়ী নগর গড়ে উঠেছিল।
গবেষকেরা জানান, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামের প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে এই সম্ভাব্য প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, যা মূলত বৌদ্ধ সভ্যতার একটি নিদর্শন। প্রায় চার মিটার চওড়া সীমানাপ্রাচীরবিশিষ্ট দুই জোড়া চতুর্স্তূপ (চারটি স্তূপ নিয়ে একটি চতুর্স্তূপ) পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এর আগে কোথাও এ রকম স্তূপের সন্ধান মেলেনি। দেয়ালের কাঠামোও বেশ অপ্রচলিত, নিচের তুলনায় ওপরে বেশি চওড়া। পাওয়া গেছে বিশালাকার আট কোনা স্তূপ, যার মাঝখানে আরেকটি আট কোনা ছোটো মণ্ডপ রয়েছে। গবেষকেরা মনে করছেন, এই মণ্ডপে বৌদ্ধদের ‘পবিত্র নিদর্শন’ (রেলিক) থাকত।
খননস্থল ঘুরে দেখা যায়, আট কোনা স্তূপের পাশেই প্রায় ১০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে অষ্টম বা নবম শতকে নির্মিত একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। পাশ দিয়ে চলে গেছে ইটের তৈরি পাকা রাস্তা। গবেষকদের মতে, এসব মন্দির, স্তূপ ও রাস্তা গড়ে উঠেছে সুপরিকল্পিতভাবে। মন্দিরসহ কয়েকটি স্থাপনার দেয়ালের ভিত্তিমূলে ‘ঝামা ইট’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ভবনকে আর্দ্রতায় দুর্বল হওয়া থেকে সুরক্ষা দিত।
চলতি বছরের গবেষণার তথ্য জানানোর জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিংচ্যাং বলেন, অতীশ দীপঙ্কর চীনাদের কাছে খুবই পরিচিত, কিন্তু খুব কম চীনাই জানে যে তাঁর জন্ম বাংলাদেশে। ইতিহাস বলে, হাজার বছর আগে অতীশ দীপঙ্কর যখন চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে যান, তখন তিনি তাঁর জন্মস্থানে ২৫ হাজার মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অতীশ দীপঙ্করের সঙ্গে এই বৌদ্ধ সভ্যতার নিবিড় সংযোগ রয়েছে। তাঁর জন্মস্থানে বৌদ্ধবিহার, মন্দির-স্তূপের সমন্বয়ে পরিকল্পিত নগরের আভাস দেখে বোঝা যায়, জন্মের পর তাঁর বেশ কিছুটা সময় এখানে কেটেছে। তবে সমন্বিত ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়। ছেলেবেলায় তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন, ১৯ বছর বয়সে পাটনার নালন্দা মহাবিহারে লেখাপড়া করতে যান। দেশে ফেরার পর সম্রাট ধর্মপালের অনুরোধে তিনি বিক্রমশিলা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অতীশ দীপঙ্কর পরে চীনা রাজার আমন্ত্রণে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় রোধের জন্য তিব্বতে চলে যান, সেখানেই তিনি মারা যান।
গবেষকেরা জানান, চলতি বছরের গবেষণায় স্তূপ কমপ্লেক্সের পাশে আরেকটি ইটের তৈরি রাস্তা ও কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রবেশপথ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া স্থাপনার নির্মাণ ও গঠনশৈলী দেখে এখানে একাধিক বসতি থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত স্থাপনার ওপর নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণের উদাহরণ রয়েছে এখানে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, হাজার বছরের প্রাচীন এ সভ্যতা মাটির নিচ থেকে তুলে আনতে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। তিনি আশা করেন, চীনের এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় নাটেশ্বর গ্রামের যে জমিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে, সেই জমির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা নরেশ চন্দ্র দাস। তিনি বিনা মূল্যে এ জমিটি গবেষণার জন্য দান করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নূহ-উল-আলম লেনিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে এ ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান, পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার প্রমুখ।