মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিলের রায় আজ বুধবার ঘোষণা করা হবে। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিলের ওপর এ রায় দেবেন।
বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রকাশিত আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকার ১ নম্বর ক্রমিকে এ রায় ঘোষণার জন্য রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি মামলা আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে। আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। এর ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় এ রায় হতে যাচ্ছে।
এদিকে সাঈদীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সহিংসতা ও যেকোনো ধরনের অপরাধ ঠেকাতে পুলিশ সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন। পিরোজপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর আগে বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার পর ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে—এমন এলাকার তালিকা করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কোনোমতেই যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির। সহিংসতায় প্রথম তিন দিনেই ৭০ জন নিহত হন।
যোগাযোগ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আশা করি, এই দণ্ড বহাল থাকবে।
সাঈদীর আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেছেন, ‘আমরা রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সর্বোচ্চ আদালতের ন্যায়বিচারের প্রতি আমরা আস্থাবান ও শ্রদ্ধাশীল।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত দুই ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত নয়টি মামলার রায় দিয়েছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ১০। তাঁদের মধ্যে আবুল কালাম আযাদ এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় আপিল করেননি। দণ্ডপ্রাপ্ত অপর সাতজন আপিল করেছেন। আপিল নিষ্পত্তি হওয়া একমাত্র মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার।
রায় দেখে কর্মসূচি দেবে জামায়াত আজ বুধবার সাঈদীর রায় হলে আরও চারটি মামলা আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকছে। এগুলো হলো জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম (৯০ বছর কারাদণ্ড), সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ (মৃত্যুদণ্ড), সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদণ্ড) ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (মৃত্যুদণ্ড) আপিল। এর মধ্যে কামারুজ্জামানের করা আপিলের শুনানি চলছে।
বিএনপির নেতা আবদুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলেও মারা যাওয়ার কারণে গতকাল মামলা বাতিল করে দেন আপিল বিভাগ।
২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদী গ্রেপ্তার হন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে। পরে ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
সাঈদীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: ট্রাইব্যুনালের রায়ে ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে দোষী সাব্যস্ত হন সাঈদী। এর মধ্যে একাত্তরে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যার দায়ে আলাদা দুটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। ওই সাজা থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন এই জামায়াত নেতা। আর রাষ্ট্রপক্ষ অন্য ছয়টি অভিযোগে সাজা চেয়ে আপিল করে, যেগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলেও ট্রাইব্যুনাল সাজা দেননি। ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর গত বছরের ২৮ মার্চ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ। তবে ওই সময় কাদের মোল্লার আপিল মামলা বিচারাধীন থাকায় সাঈদীর মামলার শুনানি শুরু হয়নি। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাঈদীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল মামলার কার্যক্রম শুরু হয়, যা ৫০ কার্যদিবসে গত ১৬ এপ্রিল দুই পক্ষের আপিলের শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়।
এই মামলায় আসামিপক্ষের সবচেয়ে জোরালো দাবি, ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। অথচ ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম তাঁর স্বামীকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছিলেন, তার এজাহারে (এফআইআর) আসামি হিসেবে সাঈদীর নাম ছিল না। পরে পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে, তাতেও সাঈদী আসামি ছিলেন না। ওই অভিযোগপত্রের অনুলিপি আসামিপক্ষ অতিরিক্ত নথি হিসেবে আপিল বিভাগে দাখিল করেছে। আসামিপক্ষ আরও দাবি করেছে, একাত্তরে পিরোজপুরে দেলোয়ার হোসেন শিকদার নামের এক রাজাকার ছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ওই রাজাকারের অপরাধকে সাঈদীর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। আর বিসাবালী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাঈদীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অথচ বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে অপহরণ করা হয়।
পক্ষান্তরে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাসংক্রান্ত যে নথির কথা আসামিপক্ষ বলছে, তা জাল ও মিথ্যা। বরিশাল ও পিরোজপুরের জেলা জজ আদালতে ওই ধরনের কোনো নথির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মামলার প্রয়োজনে আসামিপক্ষ ওই নথি তৈরি করেছে, এ জন্য সেগুলো বিবেচনা না করার আরজি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের ঘটনাও আসামিপক্ষের তৈরি করা। কারণ, ওই ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
আরও পড়ুন: