প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কষ্ট বিনিময় রমা চৌধুরীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আজ শনিবার দেখা করেছেন একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। এ সময় নিজের জীবনের কষ্টের কাহিনি বলেছেন তিনি। কিন্তু কোনো সহায়তা বা অনুদান চাননি। তাঁর এ আত্মসম্মানবোধে মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রীও নিজের কথা বলেছেন তাঁকে। আধা ঘণ্টার এই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় তাঁরা বিনিময় করেছেন পরস্পরের কষ্ট।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর রমা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে আমি আমার কষ্টের কথা বলেছি। দেশ নিয়ে আমি আমার ভাবনার কথা বলেছি। আমি কোনো সাহায্য চাইনি। আমি যে আমার কথাগুলো বলতে পেরেছি, সে কারণেই আমার অনেক ভালো লাগছে। প্রধানমন্ত্রীও আমাকে তাঁর জীবনের নানা কথা বলেছেন। এই সাক্ষাত্কারই আমার বড় পাওয়া।’
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রমা চৌধুরী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারের বর্বরতায় নিজের সন্তান-সম্ভ্রম-ভিটেমাটি সব হারিয়েছেন। এরপর চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় নিজের বই ফেরি করে বেঁচে আছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অনলাইনে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি কাড়ে। তাঁর ইচ্ছায়ই আজ দুজনের সাক্ষাত্ হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক ও রমা চৌধুরীর বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন উপস্থিত ছিলেন।
মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীর সব জেনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। এরপর আমাকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন। আমি চট্টগ্রামে যোগাযোগ করি। শুক্রবার রাতে তাঁরা ঢাকায় আসেন। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে আসেন রমা চৌধুরী। তিনি খালি পায়েই এসেছিলেন। এখান থেকে বেরিয়ে তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যান।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে কী কথা হয়েছে—জানতে চাইলে মাহবুবুল হক বলেন, ‘তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো সাহায্য চাননি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আত্মসম্মানবোধ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। দুজন দুজনের জীবনের নানা ঘটনা পরস্পরকে বলেছেন।’
আলাউদ্দিন খোকন বলেন, ‘সাক্ষাতের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী রমা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর আধা ঘণ্টা তাঁরা কথা বলেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো সহযোগিতা চাননি রমা চৌধুরী। তবে তিনি নিজের অনাথ আশ্রম গড়ার স্বপ্নের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বই বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে তিনি আশ্রম গড়তে চান।’
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তাঁর স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। এ সময় দুগ্ধপোষ্য সন্তান ছিল তাঁর কোলে। এর পরও তাঁকে নির্যাতন করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়ি। পুড়িয়ে দেয় তাঁর সব সম্পদ। নিজের নিদারুণ এই কষ্টের কথা তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে।
২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। যদিও তাঁর লেখ্যবৃত্তির পেশা একেবারেই স্বনির্বাচিত ও স্বতন্ত্র। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে প্রথম আলো।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রমা চৌধুরী গতকাল প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশটাকে আমাদেরই গড়তে হবে। দেশের মানুষকে আমি সেই কথাটিই বলতে চাই। চলুন, বিলাসিতা-উপভোগ এসব বাদ দিয়ে সবাই মিলে আমরা এই দেশ গড়ি।’