ভাইদের দাপটে চাল-ডালের দামও দিতেন না জুয়েল

জুয়েল মণ্ডল

ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের ফরিদপুর শাখা ও আঞ্চলিক শাখার তিন বছর মেয়াদি কমিটি গঠিত হয় গত বছর। পেশাজীবী ওই সংগঠনের দুটি শাখার অন্য সব কটি পদে নির্বাচন হলেও সাধারণ সম্পাদকের দুটি পদে কোনো নির্বাচন হয়নি। মণ্ডল ইসতিয়াক হাসান ওরফে জুয়েল মণ্ডলকে (৪১) সাধারণ সম্পাদকের ওই পদ দুটি ছেড়ে দিতে হয়েছে।

জুয়েল মণ্ডলের দুই ভাই ফরিদপুরের বহুল আলোচিত সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপসহকারী প্রশিক্ষক জুয়েল ক্ষমতা আর দাপটে ছাড়িয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটির সবাইকে। এমনকি ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসের জন্য বাজার করে মাছ-মুরগি, চাল–মুদির টাকাও দিতেন না জুয়েল।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার মামলায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জুয়েলকে বোয়ালমারী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর অন্য দুই ভাই বরকত ও রুবেলকেও ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। দুই হাজার কোটি টাকা মুদ্রা পাচারের মামলায় বরকত ও রুবেল বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। বরকত ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আর রুবেল ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, জুয়েল মণ্ডলকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ মামলার নথি জজ কোর্টে থাকায় আদালত রিমান্ডের শুনানির তারিখ পরে ধার্য করার সিদ্ধান্ত দিয়ে জুয়েল মণ্ডলকে জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

জুয়েল মণ্ডলের গ্রেপ্তারের পর ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে তাঁর দাপট আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন সেখানকার কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা। ওই ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন।

জুয়েল মণ্ডল ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে ২০০৩ সালে কৃষি ডিপ্লোমা পাস করেন। তাঁর সহপাঠীরা জানান, ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদল–সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে ওই ইনস্টিটিউট ছাত্রসংসদের ভিপি পদে ছাত্রলীগ–সমর্থিত প্রার্থী ফাহাদ বিন ফাইনের কাছে হেরে যান জুয়েল। তবে তখন থেকে তাঁর বিরুদ্ধে বাইরের জেলা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, নানা অজুহাতে টাকা দাবিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল।

২০০৭ সালে জুয়েল মণ্ডল উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি পান। ২০১১ সালে তিনি ডেপুটেশনে ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উপসহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে ওই ইনস্টিটিউটের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন তিনি।

অধ্যক্ষকে মারধর

জুয়েল মণ্ডলের কথা না শোনায় ২০১২ সালে ওই ইনস্টিটিউটের তৎকালীন অধ্যক্ষ খন্দকার মো. সাইফুল্লাহ মারধরের শিকার হন। এ ঘটনার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জুয়েলকে বদলি করা হয় শরীয়তপুরের একটি উপজেলায়। তবে ২০১৫ সালে তাঁর দুই ভাই বরকত ও রুবেল ফরিদপুরের রাজনীতির মূল কেন্দ্রে যুক্ত হওয়ার পর জুয়েল মণ্ডল পুনরায় ফিরে আসেন ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে। এরপর আরও লাগামহীন হয়ে ওঠেন। প্রতিষ্ঠানটির সব কেনাকাটাই তাঁর মাধ্যমে হতো।

ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের কক্ষে একটি আর প্রশিক্ষণকক্ষে আরেকটি এসি রয়েছে। এর বাইরে উপসহকারী প্রশিক্ষক জুয়েল মণ্ডল তাঁর কক্ষে এসি লাগিয়েছেন, নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। দেখে ঠিক দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো কর্মকর্তার কক্ষ বলে মনে হয় না। জুয়েলের অন্য আরেকজন সহকর্মীরও বসার কথা ছিল ওই কক্ষে। তবে জুয়েলের ভয়ে সে কথা বলারও সাহস হয়নি কারও।

বাজারের টাকাও আত্মসাৎ

ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক পদটি সব সময় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু দুই ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে জুয়েল মণ্ডল গত বছর ওই ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক হন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার পর ছাত্রাবাসের নিয়মিত বাজারের টাকাটাও আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ। ফরিদপুরের হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারের মুদি ব্যবসায়ী উত্তম কুমার সাহা, ওই বাজারের চাল ব্যবসায়ী মোল্লা ট্রেডার্সের মালিক তৌহিদ মোল্লা, ওই বাজারে মাছ ও মাংস ব্যবসায়ী এবং পশ্চিম গঙ্গাবর্দী এলাকার খড়ির ব্যবসায়ী হারুন শেখসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কাছে অন্তত তিন লাখ টাকা পাবেন।

উত্তম কুমার সাহা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁর পাওনা ৪৪ হাজার টাকা দিচ্ছেন না জুয়েল মণ্ডল। আর চালের ব্যাপারী তৌহিদ মোল্লা বলেন, ৬ মাস ধরে তাঁর ৩০ হাজার টাকাও দিচ্ছেন না জুয়েল। ‘আজ দিই, কাল দিই’ করে খালি ঘোরাচ্ছেন।

নির্বাচন ছাড়া নেতা

গত বছর নির্বাচন ছাড়াই ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের ফরিদপুর শাখা ও আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক হন জুয়েল। অভিযোগ রয়েছে, সংগঠনের সম্পাদক হওয়ার পর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদে চাকরি পাইয়ে দেবেন বলে কয়েকজনের কাছ থেকে ৮–১০ লাখ টাকা করে নেন জুয়েল মণ্ডল। এর মধ্যে পাঁচজনের চাকরি হয়। বাকিরা এখনো টাকা ফেরত পাননি। যদিও হাইকোর্টে রিটের কারণে ওই নিয়োগ বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

সংগঠনের জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের দুটি পদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তাঁর শক্তি আরও বেড়ে যায়। টাকার বিনিময়ে উপসহকারী কর্মকর্তাদের বদলি করানো এবং বদলি ফেরানোর ‘ব্যবসা’ ফেঁদে বসেন তিনি।

ফরিদপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ আবদুর রউফ বলেন, জুয়েল মণ্ডলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার সুপারিশসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গতকাল বিকেলে কৃষি বিভাগের ডিজি, পরিচালক প্রশিক্ষণ ও ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।