ভরা মৌসুমে ইলিশের খরা
এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু উপকূলের নদ-নদীতে তেমন ইলিশ নেই। বঙ্গোপসাগরেও ইলিশ ধরা পড়ছে খুবই কম। তাই বাজারে সামান্য পরিমাণ যে ইলিশ মিলছে, তার দাম নাগালের বাইরে। এতে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলে-ব্যবসায়ীরা হতাশ।
বরিশালের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই সময়ে ইলিশ মাছে সয়লাব থাকার কথা এ অঞ্চলের বাজারগুলো। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আর এ জন্য দামও নাগালের বাইরে।
গতকাল মঙ্গলবার বরিশালের পোর্ট রোডের ইলিশ মোকামে গিয়ে দেখা যায়, পাইকার, জেলে ও শ্রমিকদের প্রাণচাঞ্চল্য কম। গভীর সাগরের কোনো ট্রলার আসেনি। স্থানীয় নদ-নদীতে সামান্য যে ইলিশ ধরা পড়ে, তা নিয়ে জেলেরা এখানে এসেছেন।
পোর্ট রোড মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী বলেন, কয়েক দিন ধরে ইলিশের আমদানি খুব কমে গেছে। ভরা মৌসুমে এমন ইলিশের ঘাটতি ব্যবসায়ীদের হতাশ করেছে। গতকাল দেড় শ মণের মতো ইলিশ মোকামে এসেছে। অথচ এই সময়ে অন্তত এক হাজার মণ ইলিশ আমদানি হওয়ার কথা। এক সপ্তাহ আগেও অবস্থা এমন মন্দা ছিল না। গেল সপ্তাহে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ মণ ইলিশ আমদানি হয়। ৫০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকায়। এখন তা বেড়ে ৮০০ টাকার ওপরে। একইভাবে এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৮০০ টাকার স্থলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। ৪০০ গ্রামের নিচের ইলিশ ১০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আমদানি কম থাকায় প্রতি মণ ইলিশের দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে পাইকারি বাজারে।
খুচরা বাজারে তা আরও বেশি। নগরের বাংলাবাজার, বটতলা, চৌমাথা বাজারে গতকাল ৫০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার টাকার মধ্যে। আবার এক কেজি ওজনের ইলিশ খুচরা বাজারে দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
>ইলিশের আমদানি খুব কমে গেছে
ভরা মৌসুমে এমন ইলিশের ঘাটতি ব্যবসায়ীদের হতাশ করেছে
ভরা মৌসুমে ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে অস্বাভাবিক বলছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা জানান, দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশের সবচেয়ে বড় জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা। বঙ্গোপসাগর থেকে শত শত ট্রলারে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ আহরণ করা হয়। কিন্তু এখন তা অনেক কম। একইভাবে উপকূলের নদ-নদীতেও তেমন ইলিশ নেই। পোর্ট রোডের মৎস্য ব্যবসায়ী ইয়ার উদ্দিন বলেন, সাগরে ইলিশ ধরা না পড়ায় মোকাম ঝিমিয়ে পড়েছে। সামান্য কিছু ইলিশ বাজারে আসছে, সেগুলো সাগরমোহনা ও আশপাশের মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীর।
দক্ষিণাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইলিশ মোকাম পাথরঘাটায় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার ও জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এই মোকামে ১০০ মণের মতো ইলিশ এসেছে। অথচ এই সময়ে এক-দেড় হাজার মণ ইলিশ আসার কথা। তিনি বলেন, সাগরে ইলিশ নেই। ১০০ ট্রলার গেলে ১০টি ট্রলারে সামান্য ইলিশ ধরা পড়ে। বাকি ৯০টি খালি ফিরে আসে। আবার উপকূলের নদ-নদীতেও কোনো ইলিশ ধরা পড়ছে খুব কম। অথচ এই সময়ে মিঠাপানিতে প্রচুর ইলিশ আসার কথা।
বরগুনার তালতলীর মৎস্য ব্যবসায়ী দুলাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা, এরপর প্রজনন মৌসুমের ২১ দিনের নিষেধাজ্ঞা পার করে সামান্য কয়েক দিন ইলিশ ধরার সুযোগ মেলে। এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু এখনো সাগর-নদীতে ইলিশ মিলছে না। আমরা যে কীভাবে বাঁচব, বুঝতে পারছি না।’
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারের উদ্যোগে দেশে ইলিশের উৎপাদন অনেকাংশে বেড়েছে। দেশে মোট ইলিশ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় অবদান বরিশাল বিভাগের। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ইলিশ আহরিত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ থেকেই আহরিত হয় ৩ লাখ ৩২ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছরে দেশে আহরিত মোট ইলিশের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল থেকে আহরিত হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন, যা দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সে অনুযায়ী বরিশালেও তা প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়। চলতি অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে ৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। আর বরিশাল বিভাগে তা ৩ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ৬৬ শতাংশ।
বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেরা সাগরে যেতে পারছেন না। আশা করি, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইলিশ ধরা পড়বে। আশা করি, বরিশাল বিভাগ এবারও ইলিশ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে।’