পানিবাহিত রোগ বাড়ছে
জুনের শেষে বন্যার প্রথম ধাক্কায় বাড়িঘর ডুবেছিল মোছাম্মৎ মুন্নির। স্বামী, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারী সড়কে। পানি নেমে যাওয়ায় প্রায় দেড় মাস পর গতকাল সোমবার বাড়ি ফিরেছেন তিনি। বিধ্বস্ত ঘর ঠিকঠাক করার চেয়ে তাঁর বেশি চিন্তা শাশুড়ি মালেকা বেগমকে নিয়ে।
মুন্নি জানান, বন্যার পানির সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর শাশুড়ির পায়ে ঘা হয়েছে, সঙ্গে জ্বর। হাঁটাচলা তো দূরের কথা, দাঁড়াতেই পারছেন না তিনি। স্বামী কাজের খোঁজে গেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুই বাচ্চা আর শাশুড়িকে সামলাতেই তাঁর দিন শেষ।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পাইনপাড়া গ্রামের রাজিয়া খাতুনের অবস্থাও একই রকম। বন্যার পানিতে অর্ধেক ডুবে যাওয়া ঘরে থাকতে থাকতে তাঁর দুই পায়ে ঘা হয়ে গেছে। বাজার থেকে মলম এনে সেখানে দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানি নামলেও সুস্থ না হলে তো আর কাজে যেতে পারছেন না।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মুনির আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার আগে দিনে ১০–১৫ জন রোগী আসত পেট খারাপ আর চর্মরোগ নিয়ে। এখন ৭০–৮০ জন আসে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার এই সময়টাতে যাঁরা বাড়িঘরে ফিরছেন, তাঁদের ঘরের মেঝে ও অন্যান্য সামগ্রী ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ সময় পানিবাহিত রোগ যাতে না হয়, সে জন্য অবশ্যই পানি ফুটিয়ে বা বিশুদ্ধকরণ বড়ি দিয়ে পান করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের হিসাবে গত ৩০ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩৬ হাজার ২২৩ জন বন্যার কারণে নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ১৯৩ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৮৩৯ জন, আর মারা গেছেন ৪ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন মাদারীপুরে ১৩ হাজার ১১৫ জন।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন টাঙ্গাইলে ৩৪ জন। এরপরেই রয়েছে জামালপুরে ২৯ জন।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বন্যায় গত ২৭ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৪১ জন মারা গেছেন। বন্যায় এখনো প্রায় সাড়ে ৯ লাখ পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের অর্ধেক বাড়িতে ফিরে গেছেন। সপ্তাহখানেক আগেও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, গতকাল তা কমে ৪০ হাজারে নেমে এসেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বন্যায় মারা যাওয়া মানুষের যে তালিকা করা হয়, তাতে অন্য এলাকার মানুষ বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে পানিতে ডুবে বা নৌকাডুবিতে মারা গেলে তা–ও হিসাবে আনা হয়। আমরা শুধু বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ পানিতে ডুবে বা পানিবাহিত রোগে মারা গেলে সেই হিসাব নিই।’ তিনি আরও বলেন, বন্যায় কী পরিমাণ মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙেছে, তার হিসাব তৈরি করা হচ্ছে। খুব দ্রুত তাদের ঘরবাড়ি মেরামত করে দেওয়া হবে। এ জন্য ১১৩ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে রাস্তাঘাট ঠিক করে দেওয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি ও চিকিৎসাসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের সব কটি নদ-নদীর পানি দ্রুত কমছে। দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১০১টি পয়েন্ট সংস্থাটি পানির উচ্চতা মাপে। সেই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৮৬টি পয়েন্টের পানি নামছে। মাত্র ৮টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে আছে।